ভাষা বিকৃত হচ্ছে পর্দায়, এমনকি আঞ্চলিক ভাষাও
‘মানুষ সিস্টেমরে আপডেট কইররা সবকিছু অচল কইররা দেতেয়াসে।’ এটি একটি টিভি নাটকের সংলাপ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করে এ রকম নাটক নির্মাণের প্রবণতা বেড়েছে। সেখানে বরিশাল, নোয়াখালী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের ভাষায় কথা বলতে দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্থূল সব চরিত্রের মুখে বলিয়ে নেওয়া হচ্ছে সংলাপগুলো। টিভি নাটকে আঞ্চলিক ভাষার এমন ব্যবহার কি আঞ্চলিক ওই ভাষার জন্য কিছুটা অবমাননাকর?
বাংলা নাটক যাঁরা দেখেন, তাঁদের মোটামুটি সবারই জানা, বরিশাল অঞ্চলের ভাষায় সবচেয়ে দক্ষ অভিনেতা মোশাররফ করিম। কেননা ‘বরিশাইল্যা’ ভাষাটি তাঁর মাতৃভাষা। সব অভিনেতার ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটি হতে দেখা যায় না। এক অঞ্চলের অভিনেতার মুখে অন্য অঞ্চলের ভাষা বলানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ভাষাটিকে করে তোলা হচ্ছে বিকৃত। অথচ রংপুর অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করে তৈরি হয়েছিল নূরলদীনের সারাজীবন-এর মতো শক্তিশালী মঞ্চনাটক।
টিভি নাটকে আঞ্চলিক ভাষার অপব্যবহার নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকেই। নির্মাতা ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত মনে করেন, আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে সেই অঞ্চলের ভাষাগুলোকে বিপন্ন ও অবমাননাকর করে তোলা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়িক স্বার্থে লোক হাসানোর জন্য ভাষাকে বিকৃত করে, এমনকি আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে একরকম বিকৃত করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এতে হাসির নাটক না হয়ে সেগুলো হয়ে উঠছে হাস্যকর। অনেক ক্ষেত্রে নোয়াখালীর অভিনেতাকে দিয়ে বরিশালের ভাষা বলানোর চেষ্টা করা হয়। এতে ভাষাটি তাঁর মুখে আরোপিত শোনায়।’
দেশে টেলিভিশন চালু হওয়ার পর থেকে সেখানে প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যবহার শুরু হয়। গত শতকের নব্বইয়ের দশকেও টিভি নাটকগুলোয় প্রমিত ভাষাই ছিল প্রধান ভাষা। এ ভাষাভঙ্গি হয়ে উঠেছিল সুধী সমাজে যোগাযোগের সাধারণ মাধ্যম। কিন্তু হঠাৎ করেই আঞ্চলিক ভাষার বাড়াবাড়ি কেন? কেনই বা স্থূল চরিত্রগুলোকেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক চরিত্রে দেখা যায়? হানিফ সংকেত বলেন, ‘আড্ডা বা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা কথ্য ভাষায় চলতে পারে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক টক শো, আলোচনা, বক্তৃতা, মিডিয়াতে প্রচারযোগ্য সবকিছু হতে হবে প্রমিত বাংলা ভাষায়। অন্যদিকে আঞ্চলিক ভাষা যদি নাটকে ব্যবহার করতেই হয়, সেটাও শুদ্ধ করে বলতে হবে। কেননা বরিশাল বা নোয়াখালীর ভাষাও সেখানকার মাতৃভাষা।’
নাটকে প্রমিত বাংলার ব্যবহার কমে যাওয়ার ফল খুব বেশি ভালো নয়। এ প্রসঙ্গে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের অনেকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়। তাদের প্রায় ৯০ শতাংশ শুদ্ধভাবে ছবি তোলার প্রস্তাব করতে পারে না। একটা অদ্ভুত প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, যারা র-কে ড় উচ্চারণ করে। বাংলা ভাষা ইংরেজির মতো করে বলে। শিক্ষিত এই নতুন প্রজন্ম ধরেই নিচ্ছে যে এটা বোধ হয় স্টাইল।’
হানিফ সংকেত মনে করেন, মিডিয়ার দায়িত্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি-আচরণ এগুলোকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে। সেটা না করে বরং আমাদের যা আছে, সেগুলোকে নষ্ট করা হচ্ছে। সবাই মিলে এসব প্রতিহত করতে হবে। যারা এসব করছে তাদের জ্ঞান ও বোধের অভাব আছে। তাদের সচেতন করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি, ভাষা ব্যবহারের প্রতি আমাদের আরও বেশি সতর্ক হতে হবে।’