নিশাতের বিদায়ে স্তব্ধ ঢাকার নাট্যাঙ্গন
>ইশরাত নিশাত নাট্যদল ‘দেশ নাটক’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মঞ্চে একাধারে অভিনেত্রী, নির্দেশক ও আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। তাঁর নির্দেশনায় দেশ নাটক প্রযোজনা অরক্ষিতা প্রশংসিত হয়। অসংখ্য নাটক ও আবৃত্তি প্রযোজনায় মঞ্চ ও আলোক নির্দেশকের কাজ করেছেন। ১৯ জানুয়ারি রোববার রাত সাড়ে ১১টায় ঢাকার গুলশানে বোনের বাসায় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর নাট্যাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সে ছায়া ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও। সেসবের খবর জানাচ্ছেন মাসুম আলী।
প্রচলিত অর্থে তারকা নন তিনি। কিন্তু নাটকের মানুষ ইশরাত নিশাত যেন ছিলেন তারকাদের তারকা। মহাতারকা। নইলে কেন তাঁর চলে যাওয়ার খবর শুনে ঢাকার নাট্যকর্মীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দেয়াল হয়ে ওঠে নিশাতময়। তাঁকে শেষবার দেখার জন্য অগণিত মানুষের নীরব উপস্থিতি ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। সবার চোখে পানি। কেউ তাঁর শোকবাণী সম্পূর্ণ করতে পারল না। কথা বলতে বলতে সবাই কেঁদে ফেললেন। ফুল দিতে দিতে চোখ ভিজল সবার।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় ইশরাত নিশাত আসতেন শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। তাঁর নাটক থাকুক, বা না থাকুক। বিগত দুই দশকে নাট্যাঙ্গনে এমন কোনো আন্দোলন–সংগ্রাম হয়নি, যেখানে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। নাট্যাঙ্গনে অন্যায় হয়েছে—এমন কেউ নেই, যাকে তিনি ছেড়ে কথা বলেছেন। কিন্তু সব সময় সবার সঙ্গেই থেকেছেন হাসিমুখে। সেই সদাহাস্যমুখ ইশরাত নিশাত সোমবার অসময়ে (দুপুরে) এলেন শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। এলেন কফিনে, কাফনে মোড়া নিথর নিশাত এদিন হাসলেন না, বললেন না কোনো কথা। বিষাদে স্তব্ধ শিল্পকলা।
কে এলেন না এদিন? হুইলচেয়ারে অসুস্থ শরীর নিয়েও এসেছিলেন আলী যাকের। ভেজা দুই জোড়া চোখে দাঁড়িয়েছিলেন শিমূল ইউসুফ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ। এসেছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, আতাউর রহমান, ম. হামিদ, লাকী ইনাম, ফজলুর রহমান বাবু, মাসুম রেজা, ফারহানা মিঠু, আফসানা মিমি থেকে শুরু করে নানা প্রজন্মের বিশিষ্ট বা যশঃপ্রার্থী শিল্পীরা।
নিশাতের শেষ বিদায়ের আয়োজন সামনে রেখে শিমূল ইউসুফ বলেন, ‘আজ প্রথমবারের মতো শুধু তোর জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। তোর জন্য আলাদা করে কোনো আয়োজন করার সুযোগ তুই আমাদের দিস নাই। এমন আয়োজন চাইনি নিশু।’ কফিনের দিকটাতে লক্ষ্য করে ম. হামিদ যেন নিশাতের সঙ্গে কথা বললেন, ‘এ কেমন চলে যাওয়া নিশাত। কাল যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলে, হেঁটেছিলে আজ সেখানেই কফিনে শুয়ে আছ তুমি। এ কেমন চলে যাওয়া?’
সোমবার ভোরেই নাট্যনির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়ে দেন নিশাতের চলে যাওয়ার খবর। তিনি লেখেন, ‘বাংলাদেশের নাটকের বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর ইশরাত নিশাত, কন্যা আমার, এভাবে কি চলে যেতে হয়!’
শিল্পকলা একাডেমিতে নিশাতের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, বাংলাদেশের থিয়েটার অঙ্গনে ‘বিদ্রোহী কণ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন ইশরাত নিশাত। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁর কণ্ঠ ছিল সব সময় সোচ্চার। অসংখ্য নাটক, আবৃত্তি প্রযোজনায় মঞ্চ ও আলোকনির্দেশকের কাজ করে সংস্কৃতি অঙ্গনে তিনি নিজেকে করে তুলেছেন অনন্য।
অভিনেত্রী ও নির্দেশক হৃদি হক যা লিখেছেন তাঁর কিছুটা এমন, ‘নিশাত আপা, তোমাকে স্যালুট। কী ভীষণ শক্তি তোমার। তোমার মতো জীবনকে উদ্যাপন করতে কজন পেরেছে বলো...শিল্প ছাড়া কেউ বাঁধতে পারেনি তোমাকে...২৭ তারিখ মঞ্চে আমাদের ওপর যখন আলো পড়বে, ঠিক জেনে নেব, তুমি আমাদের দেখছ...তোমার আলোয় আমরাও চিনে নেব পথ।’ নাট্যনির্দেশক শুভাশিস সিনহা লেখেন, ‘এই চাহনিতে আমরা অনেকেই চমকে গিয়েছি, কখনো বিব্রত হয়েছি, সংকোচে পড়েছি, আমাদের সকল গতি একেকবার থমকে গেছেই এই চাহনির সামনে—কী যে বলে উঠবেন! কী যেন মনে করবেন! তারপর নাটকীয়ভাবে হঠাৎ পিঠ চাপড়ে দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠা। শিল্পকলার গেটের কোণে এই মূর্তিমান মহানাট্য আর দেখব না। এই তীক্ষ্ণ প্রশ্ন মধুর ভালোবাসা আর পাওয়া হবে না এ জীবনে।’ অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুদের লেখার একটি অংশ ছিল এমন, ‘থিয়েটারের সব সেক্টরেই তাঁর দখল ছিল। এ রকম একজন মানুষ, বন্ধু চলে গেলেন হুট করেই। ভালোই হয়েছে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা দুস্থ শিল্পীর তালিকায় আপনার নাম দেখতে হয়নি, নিশাত আপা! আসলে বেঁচে থাকাটাই আকস্মিক!’ নাট্যকর্মী শাহাদাত হোসেন লিখেছেন, ‘মঞ্চ আলোকিত করাই যাঁর ধ্যানজ্ঞান। একজন আপাদমস্তক শিল্পের মানুষ।’
বনানী কবরস্থানে বাবার কবরে শেষ ঠিকানা হয় সোমবার সন্ধ্যার পর। সুবচন নাট্য সংসদের দল প্রধান আহমেদ গিয়াস ছিলেন ইশরাত নিশাতের শেষযাত্রার সাক্ষী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘প্রিয় নিশাত আপা, অনেক দিন পরে আজ সারা দিন আপনার সাথে থেকে এইমাত্র ঘরে ফিরলাম, সাধারণত এভাবে আপনার সাথে সারা দিন থাকলে সবশেষে আমাদের ঘরে ফেরা নিশ্চিত করে আপনি ঘরে ফিরতেন। কিন্তু আজ উল্টোটা ঘটল, আপনার প্রিয় প্রাঙ্গণ থেকে নিজ ঘাড়ে করে আপনাকে আপনার শান্তির ঠিকানায় রেখে আসলাম, এভাবে এত আগেই ঘুমাতে চলে গেলেন!’