কষ্টকে 'ন ডরাই'
>২০১৬ সালে সিনেমায় অভিষেক হয় শরিফুল রাজের। ছবির নাম আইসক্রিম। এরপর তিন বছর আর সিনেমায় নেই এই নায়ক। গত বছর আবার তাঁকে দেখা ন ডরাই ছবিতে। মাঝের এই সময়টা কেমন কেটেছে রাজের? কষ্টের, সংকটের, তবে এখন অনেকটাই আনন্দের। কারণ আবার তিনি পর্দায় ফিরেছেন অনেক অনেক স্বপ্ন আর প্রত্যাশা নিয়ে। নতুন এই নায়ক শত সংকটেও সিনেমাকেই আঁকড়ে ধরে রেখেছেন ‘ন ডরাই’ বলে। তাঁর গল্প নিয়েই এবারের প্রচ্ছদ।
ডিসেম্বরে মুক্তি পায় ন ডরাই। সামনেই আসছে পরাণ। দুটো ছবিতেই অভিনয় করেছেন শরিফুল রাজ। ২০১৬ সালের পর আবার সিনেমায় ফিরলেন। এবার তাঁর ফেরা তিনটি ছবি নিয়ে— ন ডরাই, পরাণ ও হাওয়া। অনেক সংকট–সংগ্রাম পেরিয়ে আবারও সিনেমায় ডুবে থাকার আনন্দই রাজ জানালেন আনন্দকে। লিখেছেন শফিক আল মামুন।
রাজধানীর মাল্টিপ্লেক্সগুলোয় প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে চলছে ন ডরাই। মুক্তির আগে থেকেই দর্শকের এই ছবিটি নিয়ে ছিল আলোচনা–সমালোচনা। ছবিতে কক্সবাজারে স্থানীয় এক তরুণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শরিফুল রাজ। সার্ফিং করেছেন সাগরের বুকে। মাসের পর মাস সময় নিয়ে শিখেছেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা। তবেই হতে পেরেছেন এই সিনেমার নায়ক। এভাবেই প্রতিটি ছবির জন্য নিজেকে ভেঙে ভেঙে আবার নতুন করে গড়ছেন রাজ। তাই তো পরিচালকেরাও তাঁর মধ্যে দেখছেন নতুন সম্ভাবনা। এরই মধ্যে পরিচালক হিসেবে তিনি পেয়েছেন মেজবাউর রহমান সুমন ও রায়হান রাফির মতো নির্মাতাদের।
এক ছবির জন্য যত পরিশ্রম
গত ২৯ নভেম্বর মুক্তি পায় ন ডরাই। মুক্তির পর ছবিটি থেকে শরিফুল রাজের প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার সমীকরণ কতটা মিলল তা জানতে চাই। রাজ বলেন, ‘অনেক কষ্ট ও ত্যাগের কাজ এটি। ছবির কিছু দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। কিন্তু শেষ নাগাদ দর্শক সারিতে বসে ছবিটি দেখে তৃপ্তি পেয়েছি।’
প্রস্তুতি ও শুটিংসহ প্রায় এক বছর ন ডরাই ছবির সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়েছে রাজকে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সাগরে সার্ফিং শিখেছেন। তিন মাস চরিত্রের জন্য প্রস্তুতি নিতে থেকেছেন কক্সবাজারে। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে রাজ বলেন, ‘গ্রামের ছেলে হওয়াতে সাঁতার জানতাম। কিন্তু সুমদ্রের বুকে সার্ফিং করা দুঃসাহসিক এক কাজ ছিল আমার জন্য। তিন মাস কক্সবাজারে সার্ফিং শিখে রোদে পুড়ে গিয়েছিলাম। আলাদা সময় বের করে কক্সবাজারের স্থানীয় ভাষা শিখতে হয়েছে।’
শুরুর কথা
সিলেট থেকে ২০০৯ সালে পড়াশোনার জন্য ঢাকায় আসেন শরিফুল রাজ। রঙিন এই শহরটা প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ করে রাজকে। কিন্ত আর্থিক সংকট তাঁকে এক বছরও টিকতে দেয়নি এই শহরে। নারায়ণগঞ্জে মামার কাছে চলে যান। তবে পরের বছরই আবার ঢাকায় ফিরে আসেন, ভর্তি হন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দিনে ক্লাস, সন্ধ্যা হলেই ধানমন্ডি ৮ নম্বরে আড্ডা— এভাবেই কাটছিল রাজের জীবন। একটা সময় আর্থিক সংকটে লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। বন্ধু হাবিব তার মেসে জায়গা দেয় রাজকে। শুরু হয় এক ঘরে ১৫ জন ঠাসাঠাসি করে থাকা। রাজ বলেন, ‘সে এক কঠিন সময়। বন্ধুর কল্যাণে মেসে থাকার জায়গা হলো। ১৫ জন একসঙ্গে থাকি। পকেটে টাকা নেই। পড়ালেখা বন্ধ হয় হয় অবস্থা । কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার সুযোগটাও ছিল না। দিশেহারা অবস্থা আমার।’
ওই সময় ধানমন্ডির আড্ডাই কিছুটা আলোর পথ দেখায় রাজকে। সেখানে বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ আসতেন। তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয় রাজের। এই শহরে কিছু একটা করে টিকতে হবে এই ভেবে মুঠোফোন সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠান বাংলালিংকের ‘দেশ-৫’ বিজ্ঞাপনচিত্রে ‘সাইড আর্টিস্ট’ হিসেবে কাজ করেন রাজ। সেই সময় নিয়ে তিনি বলেন, ‘আড্ডায় পরিচিত হওয়া একজন নিয়ে গেলেন পরিচালক পিপলু আর খানের অফিসে। বিজ্ঞাপনচিত্রের মূল মডেল আরিফিন শুভ, সারিকা, নিলয়। বিজ্ঞাপনে আমার কাজ অনেকটা এক্সট্রার মতো। মূল মডেলের সঙ্গে ছড়ানো–ছিটানো ছেলেমেয়েদের দলে আমি। মহড়া হলো কয়েকদিন। এরপর শুটিং। প্রথম বারেই পেলাম ৮ হাজার টাকা। সেই আনন্দের কথা বলে বোঝানো যাবে না।’
ঢাকায় বাঁচতে আর চলতে এরপর থেকে প্রায়ই বিজ্ঞাপনচিত্রে বাড়তি শিল্পী হিসেবে কাজ করতে লাগলেন শরিফুল রাজ। এই সময়ের মধ্যে দুয়েক জায়গায় চাকরি ধরা এবং ছাড়াও হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে মডেলিংয়ের জগৎ ঘিরে আগ্রহ বাড়তে থাকে রাজের। ২০১১ সালে মডেল বুলবুল টুম্পার গ্রুমিং স্কুলে ভর্তি হন। ২০১২ সাল থেকে শুরু করেন মডেল হিসেবে র্যাম্পে হাঁটা। পরবর্তীসময়ে মডেল আজরা মাহমুদের সঙ্গে কাজের সুযোগ হয়। র্যাম্পের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফটোশুটেও মডেল হতে থাকেন। রাজ বলেন, ‘তখন নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে এনেছি। নিয়মিত ফটোশুট, র্যাম্পে কাজ করছি। এতে আর্থিক সংকট কিছুটা কাটে।’
হঠাৎ পাল্টে যায় দিন
২০১৫ সালের কথা। হঠাৎ একদিন বুলবুল টুম্পার ফোনে রাজকে জানান নির্মাতা রনি একটি সিনেমা বানাবেন। রাজের তলব এসেছে রনির অফিস থেকে। ‘আগে থেকেই রেদওয়ান রনির নাটকের ভক্ত আমি। টুম্পা আপার ফোন পেয়ে খানিকটা ভয়ে ভয়ে রনি ভাইয়ের অফিসে গেলাম। অডিশন হলো। পরের দিন আবার ডাকলেন। তাঁর আইসক্রিম ছবিতে কাজের প্রস্তাব করলেন। এরপরই সব বদলে যেতে থাকল।’— এভাবেই সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কথা বলতে থাকেন রাজ।
আইসক্রিম–এর জন্য প্রস্তুতি নিতে র্যাম্প, ফটোশুট বন্ধ করে দেন রাজ। কিন্তু ছবি মুক্তির পর আবারও আর্থিক সংকট আঁকড়ে ধরে তাঁকে। রাজ বলেন, ‘আইসক্রিম ছবি মুক্তির আগ পর্যন্ত অন্য কোনো কাজ করিনি। একটা সময় পকেটে এক টাকাও ছিল না। রনি ভাইয়ের অফিসেই থাকতে লাগলাম। খেয়েপরে বাঁচার জন্য পরে আবার মডেলিংয়ে ফেরার চেষ্টা করি। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে আবার র্যাম্প আর ফটোশুট করে চলতে থাকি।’ কিন্তু ২০১৯ সালে এসে একের পর এক সিনেমায় ডাক আসে। প্রথমে তানিম রহমানের ন ডরাই। এর পরপরই পরাণ ও হাওয়া ছবিতে কাজের সুযোগ হয়। পরের দুটি ছবি আছে মুক্তির অপেক্ষায়।
লক্ষ্যই সিনেমা, আছে অনিশ্চয়তা
রাজের পুরো পরিবারই সিনেমাপ্রেমী। সুযোগ পেলেই এখনো রূপবান কিংবা বেদের মেয়ে জোসনা দেখতে বসে যান রাজের মা। তাই সিনেমার ঝোঁক পরিবার থেকেই পেয়েছেন রাজ। এখন সিনেমাই একমাত্র লক্ষ্য তাঁর। আর্থিক সংকট থাকলেও একটি সিনেমা করার পর আরেকটির অপেক্ষায় থাকেন। তবু ঘাবড়ে গিয়ে হাল ছেড়ে দেন না। রাজ বলেন, ‘সিনেমাটা করতে চাই। আইসক্রিম ছবিতে কাজ করার পর সিনেমাই আমার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে গেছে। একেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই।’