'মন্দ নয়' মায়া দ্য লস্ট মাদার
বৃহস্পতিবার স্টার সিনেপ্লেক্সের ২ নম্বর প্রদর্শনকক্ষে গিয়ে দেখা গেল মানবী ঘোষ অর্থাৎ ‘মায়া—দ্য লস্ট মাদার’ সিনেমার অন্যতম মুখ্য চরিত্র ঢাকায় পৌঁছে গেছেন। সিট খুঁজে নিয়ে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, কবি ও গাইডের সঙ্গে মানবীর কীভাবে কীভাবে যেন একটা ‘রেডিমেড’ প্রেমের সম্পর্ক হয়ে গেল।
বিষয়: বীরাঙ্গনা আর যুদ্ধশিশু
‘মায়া—দ্য লস্ট মাদার’ ছবিটি ২০১৬ সালে অনুদান পেয়েছিল সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। কিন্তু ছবিটি শেষ করতে নানা কারণে তিন বছর লেগে গেল। ২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর, বছরের সর্বশেষ ছবি হিসেবে মুক্তি পায় ‘মায়া—দ্য লস্ট মাদার’। ছবিটি বরেণ্য শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের চিত্রকর্ম ‘ওমেন’ এবং কবি কামাল চৌধুরীর ‘যুদ্ধশিশু’ কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত। ‘মায়া—দ্য লস্ট মাদার’-এর চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন কবি ও 'নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ'খ্যাত নির্মাতা মাসুদ পথিক।
গল্পের শুরু আছে, শেষ নেই
কোনো গল্পেরই আসলে শুরু বা শেষ বলে কিছু থাকে না। কারণ, সব শুরুর একটা শুরু আছে। সব শেষেরও একটা রেশ থেকে যায় পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে। এই সিনেমাটিতেও চলমান ঘটনাপ্রবাহের একটা অংশকে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশি বাংলা সিনেমার চিরায়ত মিলন দৃশ্য নেই এখানে। জীবন বাস্তবতায় জীবনের গল্প কোন দিকে মোড় নিয়ে কোথায় শেষ হয়, জানা যায় না। গল্পটির শেষেও দর্শকদের মনরক্ষা করে ‘হ্যাপি এন্ডিং’ টানা হয়নি। ‘অতঃপর তাঁরা সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকল’ সেই মিথ্যেকে প্রতিষ্ঠা না করে নিষ্ঠুর বাস্তবকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন পরিচালক।
যাঁদের অভিনয়ে জীবন্ত হয়েছে চিত্রনাট্য
মায়া সিনেমার মায়া বানু প্রাণ পেয়েছে বাংলাদেশের গুণী অভিনয়শিল্পী জ্যোতিকা জ্যোতির শরীরে। তিনি চরিত্রটির সঙ্গে ন্যায়বিচার করতে পেরেছেন। মানবী চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভারতের বিখ্যাত জাদুশিল্পী পিসি সরকার জুনিয়রের মেয়ে, ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’খ্যাত মুমতাজ সরকার। যুদ্ধশিশু জব্বার পাগল চরিত্রে দারুণ মানিয়েছে প্রাণ রায়কে। আলাদা করে মনে রাখার মতো উপস্থিতি ছিল নার্গিস আকতারের। মায়ার ছেলে মুজিবের চরিত্রে ছেলেটির অভিনয় খুব সহজ, সাবলীল লেগেছে। তা ছাড়া ছিলেন দেবাশীষ কায়সার, লীনা ফেরদৌসী, ঝুনা চৌধুরী, আসলাম সানী, শাহাদত হোসেনসহ আরও অনেকে। একটি দৃশ্যে দেখা দিয়েছেন সৈয়দ হাসান ইমাম।
যা কিছু ভালো লেগেছে
এই ছবির যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে, তা মানুষ আর প্রাণীর সহাবস্থান। প্রাণ রায় আর ‘কুকুর পিংকি’র সম্পর্কের উষ্ণতা, আন্তরিকতা দারুণভাবে উঠে এসেছে। পিংকিকে তাঁর দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য ধন্যবাদ জানানোর উপায় নেই। চিত্রনাট্য আর পরিচালকের চাহিদা বুঝে পর্দায় পিংকি ঠিক তেমনটাই করেছে। পরিচালক অবশ্য সেই কৃতিত্ব দিলেন প্রাণ রায়কে। তিনি নাকি খুব অল্প সময়ে কুকুরটার সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিয়েছিলেন। একটি দৃশ্যে একটা ছোট্ট মুরগির বাচ্চা স্যান্ডেলের ওপর ডোবায় ভেসে যাচ্ছিল। যুদ্ধশিশু প্রাণ রায় যেন বুঝতে পেরেছিলেন সেই পাখির ছানার অসহায়ত্ব। পানিতে নেমে হাত বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পাখিটি খুব স্বাভাবিকভাবে হাত বেয়ে উঠল। দৃশ্যটি চোখে লেগে থাকার মতো। এই দার্শনিক পাগলের মুখ দিয়ে পরিচালক চমৎকার কিছু ডায়ালগ বলিয়েছেন। দৃশ্য গ্রহণ আর ক্যামেরার কাজে ছিল ভিন্নতা।
কিছু দৃশ্য খুবই দৃষ্টিনন্দন। বাংলাদেশের গ্রামীণ সৌন্দর্য উঠে এসেছে এই ছবির ক্যামেরার চোখে। আলাদা করে বলতে হবে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর আর গানের কথা। মমতাজ, বেলাল খান, কোনাল, ঐশী, পড়শী, পূজা আর শিল্পী বিশ্বাস—তাঁরা গেয়েছেন এই ছবির শ্রুতিমধুর গানগুলো।
দুর্বল চিত্রনাট্য আর সম্পাদনা
গল্প যথেষ্ট ধীর, কিঞ্চিৎ অগভীর। সিনেমার প্রথম অর্ধেক শেষ হওয়ার পর যখন বিরতি চলবে, তখন আপনি ভাবতে বসবেন যে এতক্ষণে কী হলো। মানবী আর তাঁর গাইডের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। মায়ার সঙ্গে জব্বারের প্রেমটাও ঠিক সহজে হজম হয় না। ক্লোজআপ শট থেকেই হঠাৎ করে এক্সট্রা ওয়াইড শট চোখে খাপছাড়া লাগে। ড্রোনভিউগুলো এলোমেলোভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এমন অনেক দৃশ্য আছে যেগুলো মূল গল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। শুধু শুধুই দেখানো হয়েছে। যুদ্ধশিশু হিসেবে ৩৩ বছর বয়সী মুমতাজকে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে মানানসই লাগেনি। হয়তো পরিচালক আরও ১০ বছর আগের প্রেক্ষাপটের গল্প বলেছেন। কিন্তু পর্দায় সেটি স্পষ্ট নয়। নার্গিস আকতারের ভাষার যে টোন, সেটা পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে মেলেনি। যখন মুজিব কথা বলে, সেটা আবার একটু ভিন্ন রকম শোনায়। একটা গ্রামের সব মানুষের যে একটা ‘কমন টোন’ থাকা উচিত, সেটা ছিল না।
পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি
প্রায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েক জায়গায় মুমতাজ সরকারকে অযথা লাল নাইটি পরা, তোয়ালে জড়ানো অবস্থায় বা বিছানার দৃশ্যে যৌন আবেদনময়ী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। একাধিক জায়গায় জ্যোতিকা জ্যোতির ক্ষেত্রেও সেটি সত্য। যেগুলো এড়িয়ে গেলে গল্পের মূল স্রোতের ক্ষতি বৃদ্ধি হতো না। শেষ দিকের একটি দৃশ্যে নার্গিস আকতার যখন মুমতাজকে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁকে কীভাবে ধর্ষণ করা হয়েছিল, সেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন সেটাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হলো, তা এক কথায় ‘নগ্ন’। নির্যাতনের বীভৎসতা বোঝাতে দৃশ্যটি ভিন্নভাবেও উপস্থাপন করা যেত। এ রকম একটি সিরিয়াস বিষয়ে এভাবে নারীর শরীর প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আরেকটু ভাবা যেত।
ছবিটির ভিন্ন মেজাজ, নান্দনিক দৃশ্য, অভিনয়, কিছু দার্শনিক সংলাপ, সংগীত-সব মিলিয়ে ‘মন্দ নয়’।