নিজের গড়া জিলাপীতেই পৃথ্বী ছাড়লেন পৃথ্বীরাজ
‘জিলাপী স্টুডিও। এখানে উন্নতমানের সংগীত পাওয়া যায়।’ এই সাইনবোর্ডের পেছনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর। এই ঘরে অনেকটা সময় কাটাতেন পৃথ্বীরাজ। তৈরি করেছেন নতুন নতুন সুর। স্টুডিওটি গড়ার সময় তিনি বলেছেন, ‘জিলাপী নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। এখানে ঢুকে ঘরটা ঠান্ডা করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসব। ছবি দেখব, গান শুনব। এখান থেকে অন্য রকম সাউন্ড তৈরি হবে। এটা একান্তই আমার নিজের জগৎ। এই ঘরটাতেই কাজ করতে করতে যদি চলে যাই, তা হবে আমার জন্য অনেক শান্তির।’
২০১১ সালে নিজের স্টুডিওতে বসে কিছু না ভেবেই বলেছিলেন পৃথ্বীরাজ। আজ তাঁর সেই চাওয়া পূরণ হয়েছে। এই জিলাপী স্টুডিওতেই কাজ করতে করতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
বছরখানেক ধরে পৃথ্বীরাজের সঙ্গে কাজ করছেন তরুণ সংগীতশিল্পী সৈয়দ নাফিস। তিনি জানালেন, গতকাল শনিবার রাতে পৃথ্বীরাজের স্ত্রীর ফোন পান তিনি। এরপর ছুটে আসেন লালমাটিয়ায় পৃথ্বীরাজের জিলাপী স্টুডিওতে। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করার পর কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি স্টুডিওর দরজা ভাঙেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন পৃথ্বীরাজের স্ত্রী নওশিন খান আর ভাই আরেক তরুণ মেধাবী সংগীতশিল্পী ঋতুরাজ।
তার আগে গতকাল রাত ১০টার দিকে কাজ করার জন্য জিলাপী স্টুডিওতে যান পৃথ্বীরাজ। এরপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাঁর স্ত্রী বারবার ফোন করেন। তিনি ফোনকল রিসিভ করছিলেন না। শুরুতে তাঁর স্ত্রী ধারণা করেন, পৃথ্বীরাজ হয়তো ফোন সাইলেন্ট করে কাজে ব্যস্ত। কিন্তু অনেকক্ষণ ফোনে কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সৈয়দ নাফিস আর ঋতুরাজকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে ছুটে যান। স্টুডিওর দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখা যায় পৃথ্বীরাজ চেয়ারেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন।
সৈয়দ নাফিস জানালেন, পৃথ্বীরাজকে উদ্ধার করে রাজধানীর সিটি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়। তখন ভোর সাড়ে চারটা। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। জানা যায়, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন পৃথ্বীরাজ। এরপর তাঁকে আবার নিয়ে আসা হয় সেই জিলাপী স্টুডিওতেই।
তরুণ সম্ভাবনাময় ও মেধাবী সুরকার, সংগীত পরিচালক ও সংগীতশিল্পী পৃথ্বীরাজ (৩৩) আর নেই। তাঁর পুরো নাম মো. পৃথ্বীরাজ চৌধুরী। কিন্তু পৃথ্বীরাজ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। গত বছর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী নওশিন খান স্থপতি।
পৃথ্বীরাজের বাবা তপন কান্তি বৈদ্য নিজেও একজন প্রখ্যাত সংগীতগুরু। ছেলের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সকালে ছুটে আসেন। এ সময় সঙ্গে আরও ছিলেন পৃথ্বীরাজের মা।
ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে ভারত যান পৃথ্বীরাজ। সেখানে তিনি অনেক প্রখ্যাত সংগীতগুরুর সান্নিধ্য পান। এ ছাড়া তিনি পড়াশোনা করেছেন গাণিতিক অর্থনীতি নিয়ে।
‘আরে আর বাঁচব কত দিন। আমাকে অনেক কিছু করতে হবে।’ কিছু না ভেবে এই বাক্য দুটি প্রায়ই বলতেন পৃথ্বীরাজ। তখন সঙ্গে থাকা শিল্পী, বন্ধু কিংবা কাছের মানুষেরা তাঁকে থামিয়ে দিতেন। কিন্তু তাঁর সেই কথাগুলো সত্যি হলো। জিলাপী স্টুডিওর বাইরে দাঁড়িয়ে সেই কথাগুলো আজ আবার মনে হলো সৈয়দ নাফিসের।
পৃথ্বীরাজ নতুন একটি কাজ নিয়ে ইদানীং খুব উত্তেজিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা ও কলকাতা থেকে একসঙ্গে প্রকাশিত হবে একটি গান। তাতে কণ্ঠ দিচ্ছেন দুই বাংলার জনপ্রিয় কয়েকজন শিল্পী। গানটি বাংলাদেশে প্রকাশ করবে এবিসি রেডিও আর ভারতের কলকাতায় ফ্রেন্ডস এফএম। গানটির উদ্যোক্তা ভারতের প্রখ্যাত সংগীতগুরু আচার্য জয়ন্ত বোসের মেয়ে রেমা বোস। আচার্য জয়ন্ত বোসের কাছে অনেক দিন শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নেন পৃথ্বীরাজ।
এরই মধ্যে কলকাতার কয়েকজন শিল্পী নাকি গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। সৈয়দ নাফিস জানান, গতকাল শনিবার রাতে জিলাপী স্টুডিওতে এই গানটির কাজ করার কথা ছিল তাঁর। এ ছাড়া শিগগিরই তাঁর আরও কয়েকটি বড় কাজ করার কথা ছিল। এর মধ্যে একটি হলো সিনেমার গান আর আবহ সংগীতের কাজ। তিনি কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, সামিউল ইসলামসহ অনেক নামী ও জনপ্রিয় নির্মাতার সঙ্গে কাজ করেছেন।
পৃথ্বীরাজ প্রায় তিন বছর ধরে এবিসি রেডিওতে কর্মরত ছিলেন। পদের নাম জ্যেষ্ঠ সৃজনশীল প্রযোজক হলেও তিনি সেখানে আরও অনেক কাজ করতেন। তার মধ্যে অন্যতম শব্দ প্রকৌশল। প্রথম আলো অনলাইনের ‘লাক্স ক্যাফে লাইভ’ অনুষ্ঠানের অন্যতম উপস্থাপকও ছিলেন। এ ছাড়া ‘লাক্স ক্যাফে লাইভ’ অনুষ্ঠানের সূচনা সংগীত তৈরি করেছেন পৃথ্বীরাজ।
প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এবার দুটি গানের ভিডিও তৈরি করা হয়। একটি হলো রবীন্দ্রসংগীত, ‘আমরা নূতন যৌবনেরই দূত। আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত।’ আর অন্যটি সলিল চৌধুরীর গান ‘সেদিন আর কত দূরে’। এই দুটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন পৃথ্বীরাজ, সজীব, প্রিয়াঙ্কা গোপ ও অণিমা রায়। গানটির ভিডিওতেও অংশ নেন তাঁরা।
গতকাল শনিবার দুপুর ১২টা ২৭ মিনিটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এবিসি রেডিওর একটি পোস্ট শেয়ার করেন পৃথ্বীরাজ। তাতে লেখা হয়েছে, ‘বিজয়ের এই মাসে আসুন আরেকবার শুনি এবিসি রেডিওর জনপ্রিয় নিবেদন “বীরাঙ্গনার গল্প”। আমাদের আজকের গল্পের নায়িকা ফুলেরা বেগম। এটি একটি সত্য ঘটনা যা লিপিবদ্ধ করেছেন শ্রদ্ধেয় সুরমা জাহিদ এবং প্রযোজনা ও বর্ণনা করেছেন আর জে শারমীন। নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো পৌঁছে দেওয়ার এটি একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।’
পৃথ্বীরাজের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, আজ রোববার দুপুরে জানাজার পর পৃথ্বীরাজকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হবে।