সন্জীদা খাতুনকে নিয়ে এক সন্ধ্যা
সন্ধ্যা হচ্ছে যখন, তখন ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ের সাজানো চেয়ারের প্রথম সারিতে বসে ছিলেন তিন বোন—সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন আর মাহমুদা খাতুন। কোনো বড় উপলক্ষ ছাড়া তিন বোনের এক হওয়া কঠিনই বটে। গতকাল মঙ্গলবার সে রকমই একটি উপলক্ষ ছিল। তাঁদের সামনে অনাড়ম্বর মঞ্চ। তাতে তিনটি চেয়ার। তার পেছনে সন্জীদা খাতুনের একটি ছবি আর তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদ। সঙ্গে লেখা ‘সন্জীদা খাতুন, তাঁকে নিয়ে এক সন্ধ্যা’। প্রথমা প্রকাশনের এই আয়োজন ছিল ছায়ানটের প্রাণ সন্জীদা খাতুনের লেখা শান্তিনিকেতনের দিনগুলি বইটি নিয়ে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান মঞ্চে এসে সূচনা বক্তব্য দেওয়ার আগেই মিলনায়তন ভরে যায় শুভাকাঙ্ক্ষীদের আগমনে।
মতিউর রহমান বললেন, ‘বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের পরদিন থেকেই সন্জীদা খাতুনের ছিল প্রতিবাদী ভূমিকা। ভাষা, সংস্কৃতি, মানসগঠনে সন্জীদা খাতুন ছিলেন, আছেন, থাকবেন। বায়ান্ন সাল থেকে শুরু করে ৬৭ বছর ধরে তাঁর সকল কার্যক্রম—সংগীত, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, বই লেখা, সর্বোপরি ছায়ানট—সব মিলে সন্জীদা আপা। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ডাকসুর সংস্কৃতি সংসদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনুষ্ঠানে সন্জীদা আপা ও শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদুল হক আমাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন।’
প্রথম আলো সম্পাদক জানিয়ে দিলেন আলোচ্যসূচি। প্রথমে বইটি নিয়ে কথা বলবেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং বইটির লেখক সন্জীদা খাতুন। এরপর থাকবে অদিতি মহসিনের কণ্ঠে কয়েকটি গান।
তাড়া ছিল রেজওয়ানা চৌধুরীর। অনুষ্ঠানে কথা বলেই তাঁকে ছুটতে হবে ঢাকার বাইরে, সেখানে গাইবেন গান। কিন্তু তিনি তাঁর ‘সন্জীদা খালা’কে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ভুলে গেলেন সময়ের কথা। গর্ব করে বললেন, ‘আমরা দুজনেই শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী।’ শান্তিনিকেতনে পড়ালেখা করার আগে সন্জীদা খাতুনের কাছে গিয়েই কয়েকটি গান ঠিকমতো শিখেছিলেন, সে কথাও স্মরণ করলেন কৃতজ্ঞতাভরে। সোমবার বইটি হাতে পাবার পর তিনি পাতা ওলটাচ্ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার তাড়া ছিল। কিন্তু সন্জীদা খাতুনের লেখার এমন আকর্ষণ যে বই শেষ না করে তিনি গাড়িতে ওঠেননি। বন্যা বললেন, ‘বইয়ে যাঁদের কথা আছে, তাঁদের সবাইকে আমি দেখেছি। কিন্তু তখন সবাই তাঁদের বার্ধক্যে। ফেলে আসা দিনগুলিতে ডুব দেওয়ার পর কিছু জিনিস যেন আবার অবয়ব ফিরে পেল। চরিত্র, জায়গা, ঘটনা—সবই পরিচিত। বইটি পড়ার সময় আবার যেন চোখের সামনে সেই মানুষদের দেখতে পেলাম। সেটি আমার এক নিশ্বাসে বইটি পড়ে ফেলার প্রথম এবং প্রধান কারণ। এত সাবলীল বইটি, গল্পের মতো না, আবার ভারী কিছু না।’
স্মৃতিচারণা করে সংগীত ভবনের লাল খাতাটির কথা বললেন তিনি। আক্ষেপ করে বললেন, পরে সংগীত ভবনের লাইব্রেরিতে আগুন লেগে সে খাতাটি পুড়ে গেছে।’
বন্যা শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন ১৯৭৫ সালে। পাপিয়া সারোয়ার গিয়েছিলেন তাঁর দুই বছর আগে, ১৯৭৩ সালে। তিনিও মঞ্চে এসে স্মৃতিচারণা করে বললেন, সন্জীদা আপার সঙ্গে পারিবারিক বন্ধন ছিল। গাছের আম, পেয়ারা দিয়ে দিতেন। শান্তিনিকেতনে ১৯৭৪-৭৫ এর দিকে দেখা হলো। ‘সন্জীদা আপা খুব হাঁটতে পারতেন। কেউই অত হাঁটতে পারত না।’
আনিসুজ্জামানও বইটি কীভাবে টেনে নিয়ে যায়, সে কথা বললেন। ‘কাল (সোমবার) দুপুরে বইটি পেয়েছি। সন্ধ্যার মধ্যে একটানা পড়ে শেষ করেছি। মীনু আপা (সন্জীদা খাতুনের ডাকনাম) শান্তিনিকেতনে কয়েক দফা গেছেন। এমএ, পিএইচডি নিয়েছেন। দেশিকোত্তম নিতে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও শান্তিনিকেতনে গেছেন, পরেও গেছেন। এই যে বারবার শান্তিনিকেতনের সঙ্গে ওঁর যোগ, তার কথাগুলো এই বইতে আছে, সব যে ধারাবাহিকভাবে আছে, তা নয়। কিন্তু তাঁর অবস্থানের চিত্রটা গোটা বই থেকে পাওয়া যায়। এর মধ্যে ওঁর ভালো লাগার বিষয়, মন্দ লাগার বিষয়—সবই আছে।’ আনিসুজ্জামান বই থেকে দুটো অংশ পড়ে শোনান। তাতে শান্তি দেব ঘোষের বিষয়ে যে রসাল বর্ণনা রয়েছে, তা শুনে দর্শক-শ্রোতারা আনন্দ পান। সন্জীদা খাতুন ‘হতাশ আমি হতাশ’ বলে যে ছড়াটি লিখেছিলেন, তার উচ্চারণও হাসির আমেজ নিয়ে আসে গোটা মিলনায়তনে।
মতিউর রহমান এরপর এসে মনে করিয়ে দেন, ১৯৫৩ সাল থেকে বেতারে, ১৯৬৪ সাল থেকে টেলিভিশনে গান গেয়েছেন সন্জীদা খাতুন। এমনকি নাটকও করেছেন। সন্জীদা খাতুনের লেখা বইয়ের সংখ্যা ছিল ২৫। শান্তিনিকেতনের দিনগুলি তাঁর ২৬তম বই। সম্পাদনা করেছেন ১১টি বই।
সন্জীদা খাতুন বইটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শুরুতেই বলেন, ‘এত মানুষকে একসঙ্গে দেখে আমার বিস্ময়ের অবধি নেই। এত মানুষ ভালোবাসা দিতে এসেছে, এই ভাগ্য কজনের হয়? আমি ধন্য। এই বইটি নিয়ে আনিস যা বলল, বন্যা যা বলল, তা থেকে একটি কথা বোঝা গেছে, যে বইটি পড়বার মতো হয়েছে। সবাই টানা পড়ে যেতে পেরেছে। সেই জন্য আমি মনে করি, সারা জীবন যে যে সাধনা করলাম, ছাত্রদের খাতা কেটে কেটে তাদের যে কষ্ট দিয়ে আমি নিজের ভাষাকে শুদ্ধ করলাম এবং সহজ করলাম, তার একটা স্বীকৃতি এখন আমি পেয়েছি। যেসব কথা আমি লিখেছি শান্তিনিকেতনের দিনগুলিতে, সেসব লিখবার বাসনা আমার ছিল না। কিন্তু একজনের অনুরোধে আমি বইটা লিখেছি। লিখবার সময় একটানা লিখে গেছি, এখন ভাষাতে আমি অনেক দোষ দেখতে পেলাম। আমি জানি না, আনিস কেন আমাকে ছেড়ে দিল। ভাষাতে যথেষ্ট দোষ আছে। কিন্তু তবু অন্য রকম আকর্ষণ তাঁরা বোধ করেছেন, এই জন্য আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।’
এরপর নানা বিষয়ে সন্জীদা খাতুন কথা বলেন। বিশেষ করে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া প্রসঙ্গে তাঁর ভাষ্য দখল করে নেয় দর্শক-শ্রোতার মন। তিনি বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গান আমি প্রাণভরে গেয়েছি।’
এরপর ছিল শিল্পী অদিতি মহসিনের গান। সন্জীদা খাতুনের পছন্দের গান ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’, ‘সার্থক জনম আমার’ ও ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব’ গান তিনটি পরিবেশন করেন অদিতি।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পার্থ তানভীর নভেদ, রুচিরা তাবাস্সুম নভেদ, রামেন্দু মজুমদার, গোলাম মুরশিদ, সিদ্দিকা জামান, শামসুজ্জামান খান, হাসনাত আবদুল হাই, সাইফুদ্দৌলা, আবুল হাসনাত, আবুল খায়ের, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, সৈয়দ আবুল মকসুদ, মোহিত কামাল প্রমুখ।