প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঋষিজের গুণীজন সংবর্ধনা
‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে’—চারণকবি মুকুন্দ দাসের অভয়বাণীকে কণ্ঠে ধারণ করে ১৯৭৬ সালের ২২ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ঋষিজ। এই সংগঠনের দলীয় সংগীতের শেষ চারটি চরণ এমন: ‘তমসার ক্ষণে নেব ঋষিজের নাম/ উৎসব দিনে নেব ঋষিজের নাম/ উজ্জ্বল সূর্যের আলোকিত বন্যায়/ মুক্তির সুরে ঋষিজের গান’—ঋষিজের এই গানটির মতোই তাদের পথচলা। সংস্কৃতি পরিচর্যার প্রত্যয় নিয়ে সংগঠনটির যাত্রা শুরু। সংস্কৃতির শক্তিতে সম্প্রীতির রূপরেখা বিনির্মাণের প্রত্যয়ে গড়ে ওঠা সংগঠনটি সময়ের স্রোতোধারায় পূর্ণ করেছে প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছর। সাফল্যের সেই উদ্যাপনে শনিবার সংগঠনের পক্ষ থেকে আনন্দ আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার সঙ্গে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় সাজানো সেই অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দেওয়া হয় ছয় গুণীজনকে।
আজীবন সম্মাননা জানানো হয় সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সম্মাননা পেয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন। চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে কোহিনূর আক্তার সুচন্দাকে। এ ছাড়া সংগীত ও অভিনয় শাখায় সম্মাননা পেয়েছেন কুমার বিশ্বজিৎ ও মাহমুদ সাজ্জাদ। অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করা হয় প্রয়াত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ মতিউল হক খান ও সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দীকে।
গতকাল শনিবার বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সম্মেলক কণ্ঠে জাতীয় সংগীত ও ‘আমরা ঋষিজ করি’ শীর্ষক ঋষিজের সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন তথ্যসচিব আবদুল মালেক ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি বিশিষ্ট গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর। ফকির আলমগীর ৪৩ বছর ধরে নিজ প্রচেষ্টায় একটি সংগঠন পরিচালনা করছেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠনটি সময়ের দাবি মিটিয়েছে। একই সঙ্গে বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করেছে। বাংলাদেশের গণসংগীতের ধারা সমৃদ্ধ করতে ঋষিজের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বিশিষ্টজনেরা এভাবেই মূল্যায়ন করেন ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর পথচলাকে।
সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হাতে স্মারক ও সনদ তুলে দেওয়ার পাশাপাশি উত্তরীয় পরিয়ে দেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বিদেশ থাকায় তাঁর পক্ষে এই পদক গ্রহণ করেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কে এম খালিদ বলেন, দীর্ঘ একটা সময় ধরে একই ধারাবাহিকতায় একটা সংগঠনকে টেনে নেওয়া খুব কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটিই ঋষিজ করে আসছে। দেশের যেকোনো ক্রান্তিকালে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী তাদের গান নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। গণসংগীতকে অবলম্বন করে তারা ৪৩ বছর ধরে মানুষের বঞ্চনার কথা বলেছে। গানে গানে শুনিয়েছে মানুষের মুক্তির প্রেরণা। তথ্যসচিব আবদুল মালেক বলেন, মানবিক সমাজ বিনির্মাণে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক আন্দোলন। দেশপ্রেম প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম এই সংস্কৃতি। সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে নির্মূল করতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ বলেন, এই মঞ্চে ঋষিজ যাঁদের সম্মান জানাল, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাই তাঁদের সম্মান জানানোর মধ্য দিয়ে ঋষিজ আজ নিজেও সম্মানিত হলো। নাট্যব্যক্তিত্ব মাহমুদ সাজ্জাদ বলেন, ‘আমি নিজেকে কখনোই গুণীজন মনে করি না। আমি একজন সেবকমাত্র। আমাকে দর্শক সম্মানিত করেছেন, ঋষিজ সম্মানিত করল। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। স্কুলজীবন থেকেই আমি অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছি। তবে এই পুরস্কার আমাকে আকাশের সমান করেছে।’ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব কোহিনূর আক্তার সুচন্দা বলেন, ‘বাংলার বিশিষ্ট সাংস্কৃতিকজনদের চেতনা লালন করে পথ চলছে ঋষিজ। এই পথচলা আরও দৃঢ় ও সুগম হোক, এই প্রত্যাশা করি।’
অনুভূতি প্রকাশ করে ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘ফকির আলমগীর ৪৩ বছর ধরে একক চেষ্টায় একটি সংগঠন পরিচালনা করছেন, সেটা সহজ কথা নয়। বাংলাদেশের গণসংগীতের ধারা সমৃদ্ধ করতে ঋষিজের অপরিসীম অবদান রয়েছে। তারা সময়ের দাবি মিটিয়েছে। একই সঙ্গে বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লালন করেছে। সেই প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে যে সম্মাননা জানানো হলো, তাতে আমি গর্বিত ও আনন্দিত।’
আলোচনা শেষে ছিল নৃত্য-গীত ও আবৃত্তিতে সজ্জিত সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। দলীয় সংগীত পরিবেশন করেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ক্রান্তি, স্বভূমি, আনন্দন, আলতাফ মাহমুদ সংগীত বিদ্যানিকেতন ও ঋষিজের শিল্পীরা।