'বড় বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছিল'
১৯৯৬ সালের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তন। কোনো নাম ছাড়াই সরাসরি গান পরিবেশন করত ব্যান্ডটি। তাদের পরিবেশনায় মুগ্ধ হয়ে দর্শক ব্যান্ডের নাম জানতে চায়। কিন্তু তারা ব্যান্ডটির নাম ঠিক করতে পারছিল না। একসময় কোনো নাম ছাড়া ব্যান্ডটির নাম রাখা হয় ‘শিরোনামহীন’। এখন এই নামেই অনেক মনে জায়গা করে নিয়েছে গানের এই দল।
২০০৪ সালে জাহাজী অ্যালবামের মধ্য দিয়ে পুরোদস্তুর যাত্রা করে শিরোনামহীন। এ পর্যন্ত পাঁচটি একক অ্যালবাম এবং সাতটি মিশ্র অ্যালবাম প্রকাশ করেছে তারা। সর্বশেষ অ্যালবাম শিরোনামহীন শিরোনামহীন প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের ১৯ জুলাই। এখন দলে আছেন জিয়াউর রহমান (বেজ ও সম্পাদনা), সাফিন (ড্রাম), দিয়াত খান (গিটার), সাইমন (কি–বোর্ড) ও শেখ ইশতিয়াক (কণ্ঠ)।
ব্যান্ডের ৬ নম্বর অ্যালবামের পাঁচটি গান মুক্তি পেয়েছে এরই মধ্যে। সেগুলো বেশ সমাদৃতও হয়েছে। সেই অ্যালবাম, গান ও পথচলার ২৩ বছরের গল্প শুনতে সম্প্রতি আমরা হাজির হয়েছিলাম ‘শিরোনামহীন’-এর প্র্যাকটিস প্যাডে। দলের সবাই উপস্থিত ছিলেন আলাপে। তবে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে দলকে ধরে রাখা সদস্য হিসেবে জিয়া জবাব দিয়েছেন বেশির ভাগ প্রশ্নের। আর পাশে বসে তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন দলের বাকিরা।
১০ বছর আগে অ্যালবাম প্রকাশ করতে গেলে যেমন সংগ্রাম করতে হতো, এখনই তেমন কষ্ট করতে হয়?
উত্তর: আমাদের প্রথম দুটো অ্যালবাম বেরিয়েছে ক্যাসেট আকারে। তৃতীয় অ্যালবাম থেকে তা বদলে সিডি হয়ে যায়। এখন এই দুটোর কোনোটিই আর তেমন জনপ্রিয় মাধ্যম না। এখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শিল্পীদের পছন্দের প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব। এ ছাড়া আমাদের দেশি কিছু প্ল্যাটফর্ম আছে। যেমন: ইমাজিন রেডিও, গান আর টেলিকম কোম্পানিগুলোর গানভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম এখন শ্রোতা ও শিল্পী দুই পক্ষের কাছে কমফোর্টেবল হয়ে উঠেছে। তাই এখন সিডি/ক্যাসেট নয়, এসব প্ল্যাটফর্মে অ্যালবাম প্রকাশ করার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। ইউটিউব যেহেতু প্রত্যেকে ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাই সেখানকার জন্য ভিডিওটা প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই এখন সময়ের চাহিদা মানতেই ভিডিওর দিকে ঝুঁকতে হয়।
আপনাদের ৬ নম্বর অ্যালবাম সম্পর্কে কী কী জানাবেন শ্রোতাদের? কতগুলো গান থাকছে...
উত্তর: কতগুলো গান আসবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। সিডি অথবা পেনড্রাইভ, এ রকম ইউজুয়াল ফরম্যাটেই ছাড়া হতে পারে অ্যালবামটা।
অনেকেই গান শোনে, কিন্তু সবাই সংগ্রহকারী নয়। আমরা যে অ্যালবামটা রিলিজ করব, সেটা আসলে সংগ্রহকারীরাই সংগ্রহ করবেন। এটা অনেকটা বই আকারে প্রকাশ করা হবে। সেখানে গানের কথা থাকবে, গানের পেছনের গল্প থাকতে পারে। অনেক কন্টেন্ট থাকবে, যা সিডি সংগ্রহকারীদের আকর্ষণ করতে পারে। যাঁরা আমাদের গানকে অনেক বেশি ভালোবাসেন, এই অ্যালবামের সিডি/পেনড্রাইভ সংস্করণটা হবে তাঁদের জন্য।
কবে মুক্তি পাচ্ছে সম্পূর্ণ অ্যালবাম?
উত্তর: আশা করছি, ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে অ্যালবাম প্রকাশ করতে পারব। তবে এটা চূড়ান্ত নয়। কারণ, আগে আমরা ভিডিও নিয়ে ভাবতাম না। দেখা যাচ্ছে, আটটা গান নিয়ে কাজ চলত। হয়ে গেলে ছেড়ে দেওয়া যেত। এখন সেটা করা যায় না। গান তৈরির পর ভিডিও করা, সম্পাদনার কাজ থাকে। পুরো ব্যাপারটা গুছিয়ে গান প্রকাশ করতে অনেক সময় লেগে যায়।
এবারের অ্যালবামে নতুন কী কী থাকছে?
উত্তর: এই অ্যালবামে আমরা এমন কিছু কাজ করছি, যা আগে করিনি। যেমন, মাস্টারিংটা দেশের বাইরে করছি। আমাদের এই অ্যালবামের কয়েকটা ভিডিওর পরিকল্পনা আছে, যা হবে আন্তর্জাতিক মানের। ভালো কাজ করতে গেলে সময়টা একটু বেশি লেগে যায়। গান একদম তৈরি, কিন্তু শুধু গান তো আর এখন আগের মতো করে ছেড়ে দেওয়া যায় না।
শুনলাম আপনাদের এর পরের গানের নাম ‘পারফিউম’...
উত্তর: এখন পর্যন্ত আশা করছি ‘পারফিউম’ হবে আমাদের পরবর্তী গান। যদিও ‘এই অবেলায়’ এর আগেই সেটা বের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ‘পারফিউম’-এর কাজ এখনো সিঙ্গাপুরে চলছে। গানে ভিএফএক্সের কাজ আছে। সেটা করছে মার্কিন, রুশ, চীনা, ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তৈরি একটা আন্তর্জাতিক দল। সেই দলের যে পরিচালক, তিনি হলিউডের এক্স মেন: ডেইজ অব ফিউচার পাস্ট ছবির ভিজ্যুয়াল ইফেক্টসের কাজ করেছেন। ওরা অনেক গুছিয়ে কাজ করে। পুরোটাই একটা লম্বা প্রক্রিয়া। এই কারণে এত বেশি সময় লাগছে।
এখন পর্যন্ত শিরোনামহীনের করা স্মরণীয় কনসার্ট কোনটি?
উত্তর: এটা বলা খুবই কঠিন। শ্রীলঙ্কাতে ২০১৪ সালে আমরা একটা গল মিউজিক ফেস্টে গিয়েছিলাম। আন্তর্জাতিক উৎসব হওয়ায় নরওয়ে, ব্রাজিল, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রোতা ও ব্যান্ডের সমারোহ হয়েছিল। আমরা একসঙ্গে একটা রিসোর্টে ছিলাম। তখন আমরা অনেক উপভোগ করেছি।
২০১৪ সালে শিরোনামহীনের শ্রীলঙ্কায় সফরের সময়ে একটা নিউজ হয়েছিল, আপনাদের নতুন অ্যালবামের একটা গান ‘সিংহলি’ ভাষায় হবে। সেটার কী হলো?
উত্তর: আমরা যখন শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলাম, একটা স্টুডিওতে আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ওখানে যিনি কাজ করতেন, তিনি আমাদের গানগুলো খুব পছন্দ করেছিলেন। তাঁরা প্রস্তাব করেছিলেন, শ্রীলঙ্কায় আমাদের গান অ্যালবাম হিসেবে রিলিজ করতে চান। তবে সেটা সিংহলি ভাষায় হতে হবে। আমরাও তখন আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু পরে ওই কাজটা এগোয়নি আর।
শেখ ইশতিয়াক, আপনি ব্যান্ডে যোগ দিয়েছেন ২০১৭ সালে। একটা নতুন পরিবেশ, নতুন ব্যান্ড, এই যে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা, সেটা কেমন ছিল?
উত্তর: আমি শিখতে পছন্দ করি। এখনো শিখছি। শিরোনামহীন শেখার জন্য একটা বিশাল জায়গা। আমাদের বেশির ভাগ সময় কাটে স্টুডিওতে বা কনসার্টে, ট্যুরে, গাড়িতে। ব্যান্ডের সঙ্গে যতক্ষণ থাকা হয়, ওই সময়টা আমার জন্য সেরা সময়। একসঙ্গে কাজ করা, গান করা আমি উপভোগ করি।
কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণী, যাঁদের ব্যান্ড করা বা এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা। কিন্তু পারিবারিক বা সামাজিক কারণে এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারছেন না। তাঁদের জন্য কি আপনাদের কোনো পরামর্শ আছে?
উত্তর: আমরা আসলে মিউজিককে একটা স্বতন্ত্র পেশা হিসেবে এই দেশে দাঁড় করাতে পারিনি। দেশের মিউজিশিয়ানদের সেভাবে সম্মান করতে পারিনি। যে কারণে আজম খানকে হতদরিদ্র অবস্থায় মারা যেতে হয় বা লাকি আখান্দের চিকিৎসার জন্য চ্যারিটি কনসার্ট করতে হয়।
আমরা সামাজিকভাবে এতটুকু উন্নতি করিনি যে সংগীতশিল্পীরা পেশাদার ভঙ্গিতে তাঁদের চর্চা করতে পারবেন, আয় করতে পারবেন। আমাদের সেই সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এটা আমাদের সবার দায়িত্ব।
শিরোনামহীন ৩৯টা ইনস্ট্রুমেন্ট (বাদ্যযন্ত্র) ব্যবহার করেছে রবীন্দ্রনাথ অ্যালবামে। নতুন অ্যালবামে কতগুলো ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে?
উত্তর: এখন পর্যন্ত ৯–১০টার মতো ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। একজন মিউজিশিয়ানের সাধারণত একটা নির্দিষ্ট যন্ত্রবাদনে দক্ষতা থাকে। কিন্তু আমরা নিজেদের এভাবে প্রস্তুত করার চেষ্টা করেছি, যাতে আমরা একাধিক যন্ত্র বাজাতে পারি। একদম শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমরা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
শিরোনামহীনের জন্য টার্নিং পয়েন্ট...
উত্তর: আসলে প্রথম অ্যালবামটাই আমাদের টার্নিং পয়েন্ট। প্রথম অ্যালবামটা ওভাবে সমাদৃত না হলে কিন্তু শিরোনামহীন এই পর্যায়ে নাও আসতে পারত। বড় বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছিল, আমাদের প্রথম অ্যালবামকে রিজেক্ট করেছিল। ওটা যদি প্রকাশ না হতো, তাহলে হয়তো আমরা মিউজিকই করতাম না।
প্রথম অ্যালবাম: জাহাজী (২০০৪)
প্রথম গান: কাঁটাতার, মানববন্ধন (১৯৯৭)-প্রথম দুটো রেকর্ড করা গান, যা কখনো মুক্তি পায়নি।
দ্বিতীয় দফায় মুক্তিপ্রাপ্ত তিনটি গান: শুভ্র রঙিন, শহরের কথা, হাসিমুখ।
প্রথম অ্যালবামের আগে রেকর্ড করা বা রেকর্ড ছাড়া গান ছিল প্রায় ৫০টা, যার অনেকগুলো রিলিজ পায়নি কখনো।
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য: জিয়াউর রহমান, জুয়েল (গিটার), বুলবুল হাসান (কণ্ঠ)
এখন পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত অ্যালবাম: ৫টি (ষষ্ঠ অ্যালবামের কাজ চলছে। নাম নির্ধারণ করা হয়নি)
প্রথম বাণিজ্যিক কনসার্ট: ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিএসসিতে (১৯৯৬)
প্রথম উপার্জন: ৫ হাজার টাকা, বুয়েট কনসার্টে (১৯৯৯)
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: মুসাব্বির হুসাইন