নজরুলের নারীরা
পল্টন–ফেরত হাবিলদার নজরুলের একটা ছবি, যেখানে তিনি সৈনিকের উর্দি পরে একটি কামানের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, সেই ছবিটাই স্থায়ী হয়ে গেল আমাদের মনে। ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য’ নিয়ে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে এসে হাজির হয়েছিলেন কবি নজরুল ইসলাম। কিন্তু ‘রণতূর্য’ নিয়ে যত আলোচনা, ‘বাঁশের বাঁশরী’ ঠিক সে রকম মর্যাদা পেল না। রমণী–হৃদয় উতল করা তাঁর বাঁশির সুর, গানের বাণী, তাঁর কবিতা পঙ্ক্তিতে প্রেমিক–হৃদয়ের আকুতির উত্স সন্ধান করা হয়নি খুব একটা। ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার কণ্ঠ, তাঁর জেলজীবন, অনশন ও মুক্তির গান আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে যুগে যুগে। তাই তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’। কিন্তু প্রেমিক কবিকে কতটা চিনি?
সেই কোন কৈশোরে এক বালিকার চুলের কাঁটা কবির হৃদয়কে কতটা বিদ্ধ করেছিল, আদৌ করেছিল নাকি নেহাত রোমান্টিক ভাব-কল্পনারই অংশ সেটা, তা আমরা জানি না। তবে তাঁর প্রথম প্রেমিকা নার্গিসকে জানি। ঠিকানা-ঠিকুজিসমেতই জানি।
সেটা ১৯২১ সাল। অগ্রজপ্রতিম বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুর গ্রামে বেড়াতে এসেছিলেন কবি। হুল্লোড়ে স্বভাব, আপন-পরের সীমানা ভেঙে দিয়ে ঘরের মানুষ, মনের মানুষ হয়ে ওঠা যেন তাঁর আজন্ম অধিকার। খান পরিবারেরও আপনজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দুমাসেরও বেশি সময় ধরে এই গ্রামেই কাটিয়ে দিলেন তিনি। সেখানে আলী আকবর খানের পিতৃহীন সুন্দরী ভাগনি সৈয়দা আসার খাতুনের প্রেমে পড়ে গেলেন। ভালোবেসে তাঁর নাম দিলেন নার্গিস। অসংখ্য গানে-কবিতায় সেই প্রেমের স্বীকৃতি—
নার্গিস বাগ-মে, বাহার কি আগমে
ভরা দিল দাগমে,
কাঁহা মেরি পিয়ারা, আও আও পিয়ারা।।
প্রথম দিকে নার্গিসের দিক থেকে সাড়া তেমন ছিল না। কিন্তু তমালতলে, যমুনার তীরে শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি বেজে উঠলে রাধার মন উচাটন হবে না তা কি হয়? শেষ পর্যন্ত নার্গিসও সমর্পিতা হলেন কবির প্রেমে। সেই প্রেম পরিণয় পর্যন্ত গড়াল। আলী আকবর খান ও তাঁর পরিবার নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের বিয়েতে সানন্দ সম্মতি দিয়েছিলেন। বিয়ের কার্ড ছাপানো হয়েছে, নিমন্ত্রণ করা হয়েছে আত্মীয়স্বজনসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের। কিন্তু বিয়ের রাতেই কী এক দুর্লঙ্ঘ্য বাধা এসে দাঁড়াল দুই মিলন পিয়াসীর সামনে। কাবিননামার ‘অপমানকর’ শর্ত, না অন্য কোনো অজ্ঞাত রহস্যময় কারণে বেঁকে বসলেন নজরুল। নজরুল গবেষকদের কেউ বলেন আকদ হয়েছিল, কেউ বলেন হয়নি, বিয়ের আসর থেকেই উঠে গিয়েছিলেন ক্ষুব্ধ কবি। কেউ বলেন সেই রাতেই দৌলতপুর থেকে কুমিল্লা শহরে চলে গিয়েছিলেন, কেউ বলেন, না সেই রাতে নয় পরদিন ভোরে দৌলতপুর ছেড়েছিলেন তিনি। নার্গিসকে বলে এসেছিলেন শ্রাবণ মাসে এসে তাঁকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু ‘শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এল না।’ নজরুল আর কখনোই যাননি দৌলতপুরে। ১৭ বছর কবির জন্য প্রতীক্ষা করেছিলেন নার্গিস। এর মধ্যে কয়েকবার চিঠিপত্রের যোগাযোগ হয়েছিল।
নার্গিসের এক অভিমানক্ষুব্ধ চিঠির উত্তরে লিখেছিলেন, ‘দেখা? না-ই হলো এ ধুলির ধরায়। প্রেমের ফুল এ ধুলিতলে হয়ে যায় ম্লান, দগ্ধ, হতশ্রী। তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাস, আমাকে চাও, ওখান থেকেই আমাকে পাবে। লায়লী মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মতো করে কেউ কারো প্রিয়তমকে পায়নি।’
এসব আপ্তবাক্যের ভার বহন করা কি নবীন যৌবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো একটি মেয়ের পক্ষে সম্ভব? নার্গিসের দিন কেটেছে তাই এক অনন্ত অপেক্ষায়।
কিন্তু সম্পর্কটা আর জোড়া লাগেনি। ১৭ বছর অপেক্ষার পর নার্গিস বিয়ে করেছিলেন আজিজুল হাকিম নামের আরেকজন অনতিখ্যাত কবিকে। বিয়ের সংবাদ পেয়ে নজরুল চিঠির সঙ্গে একটি গান লিখে পাঠিয়েছিলেন নার্গিসকে—
পথ চলিতে যদি চকিতে
কভু দেখা হয় পরান প্রিয়
চাহিতে যেমন আগের দিনে
তেমনি মদির চোখে চাহিও।
অর্থাৎ কবি নিজে ফিরে এলেন না, গ্রহণ করলেন না প্রেমাকাঙ্ক্ষিতাকে, কিন্তু সেই নারী যেন চিরকাল তাঁর কথা স্মরণ করেন সেই দাবিটুকু জানিয়ে রাখলেন।
নার্গিস অপেক্ষা করেছিলেন ১৭ বছর। কিন্তু কবির অপেক্ষা মোটেও প্রলম্বিত হয়নি। বিয়ের দিন বা মতান্তরে পরের দিন নার্গিসের বাড়ি থেকে চলে গিয়ে উঠেছিলেন কান্দিরপাড়ে একটি হিন্দুবাড়িতে। সেখানে নতুন করে প্রেমে জড়ালেন। সেই সেনগুপ্ত পরিবারের মেয়ে দুলি বা দোলনচাঁপার প্রতি অনুরাগ যেন ভুলিয়ে দিল তাঁর সদ্য বিচ্ছেদের বেদনা। আবার কবিতা-গানের ঝরনাধারা প্রবাহিত হলো তাঁর কলম থেকে। দোলনচাঁপাকে নিয়ে লিখলেন—
হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে
আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ তলে এসে।
কবি দোলনচাঁপার নতুন নাম দিলেন—প্রমীলা। এই অসবর্ণ প্রেম সেনগুপ্ত পরিবার কিছুতেই মানতে পারল না। প্রমীলার মা বিধবা গিরিবালা সেনগুপ্ত পরিবার থেকে বেরিয়ে তাঁর মেয়েকে নিয়ে গিয়ে কলকাতায় বিয়ে দিলেন নজরুলের সঙ্গে। সেটা ১৯২৪ সাল। সে যুগে বড় সহজ ছিল না দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মিলন ও বিবাহ। শেষ পর্যন্ত বন্ধু শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় প্রমীলার সঙ্গে সংসার পাতলেন নজরুল।
কিন্তু পথভোলা পথিককে ঘরে বাঁধবে কে? নজরুল ছুটে বেড়ালেন পথ থেকে পথে। ঘর-সংসারে যেমন থিতু হতে পারেন না, তেমনি অনন্ত প্রেমের তৃষ্ণাও যেন নিবারিত হয় না। ১৯২৮ সালে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’–এর দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসে পরিচয় হলো ফজিলতুন্নেসা নামের এক শ্যামাঙ্গী তরুণীর সঙ্গে। ফজিলতুন্নেসা বিদুষী নারী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী। গণিত বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। ঢাকা ইডেন কলেজ, কলকাতা বেথুন কলেজের এই কৃতী ছাত্রীটি নজরুলের কাব্যানুরাগী ছিলেন বটে, কিন্তু নজরুলের প্রেমের প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি। এই প্রত্যাখ্যান নজরুলকে কী রকম বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল, সেটা তাঁর বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা চিঠিগুলো পড়লে বোঝা যায়। অজস্র গান-কবিতায় নজরুলের বেদনাদীর্ণ হৃদয়কে অনুভব করি আমরা। খেদ্ করে লিখেছিলেন—
নাইবা পেলাম আমার গলায় তোমার গলার হার
তোমায় আমি করব সৃজন এ মোর অহংকার।
ফজিলতুন্নেসাকে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন ‘সঞ্চিতা’ উত্সর্গ করতে চেয়েছিলেন কবি। কিন্তু তাঁর এই প্রস্তাবটিও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বস্তুত কবির সঙ্গে এই নারীর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু নিজের কেরিয়ার নিয়ে সচেতন ফজিলতুন সাময়িক মোহের জালে পড়ে নিজের উচ্চকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিতে রাজি ছিলেন না। ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড চলে যান ফজিলতুন্নেসা। সেখানে শামসসুজ্জোহা নামের এক উচ্চশিক্ষিত যুবকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। দেশে ফিরে এসে বিয়ে করেছিলেন তাঁরা। এই বিয়ের সংবাদ শুনে বিরহকাতর নজরুল লিখেছিলেন—
বাদল বায়ে মোর নিভিয়া গেছে বাতি
তোমার ঘরে আজ উত্সবের বাতি
তোমার আছে হাসি আমার আঁখি জল
তোমার আছে চাঁদ, আমার মেঘদল।
নার্গিস, প্রমীলা, ফজিলতুন্নেসা ছাড়াও আরও বেশ কজন নারীর সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই সম্পর্ক ‘প্রেম’ কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু জাহানারা চৌধুরী, রানু সোম (প্রতিভা বসু) বা নোটন মৈত্র প্রমুখের সঙ্গে নজরুলের নানা মাত্রার সম্পর্ক এখনো আগ্রহ ও কৌতূহলের বিষয়। গানে–কবিতায় এই নারীদের স্মরণীয় করে রেখেছেন তিনি। আর এ কথা তো অনস্বীকার্য, নজরুলের প্রেম ও বিরহের গান ও কবিতা এখনো বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।