একজন বব ডিলান
না, সাধ মিটল না। দেখা মিলল না বব ডিলানের। জানিয়ে দিয়েছেন তিনি আসছেন না স্টকহোমে। মন খারাপ না হয়ে উপায় আছে?
স্টকহোমে তখন সূর্যের দেখা মেলা ভার। অন্ধকার হয়ে থাকে দিন। গামলাস্তানের নোবেল মিউজিয়ামেই শুধু আলোর দেখা পাই। সে আলো ছড়ান নোবেল বিজয়ীরা। কম্পিউটারের বোতাম টিপলেই ইতিহাসের নানা জায়গা থেকে বেরিয়ে আসেন তাঁরা। কিন্তু সেখানে তখনো বব ডিলান নেই। সেখানে কেবল বৃষ্টি আর তুষারপাতের ঘনঘটা।
বলছি ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের কথা। নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠান কাভার করতে গেছি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে। সে বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন বব ডিলান। তাঁকে দেখব এই ছিল আশা।
ঢাকা থেকে প্লেন বিলম্ব করেছিল, তাই স্টকহোমের প্লেন মিস করে দোহায় থাকতে হলো রাতটা। নোবেল অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে পৌঁছাতে পারব কি না, তা নিয়ে ছিল শঙ্কা। আরও শঙ্কা ছিল সেবারের নোবেল পুরস্কারের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি বব ডিলান আসছেন কি না, সেটা জানতে না পারায়।
শেষ পর্যন্ত তিনি আসেননি। শেষ পর্যন্ত সুরের মায়াজালে বন্দী হয়নি নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠান। অন্য নোবেল বিজয়ীদের দেখলাম স্বচক্ষে। অংশ নিলাম প্রায় সব অনুষ্ঠানেই। কিন্তু কোথাও ছিলেন না বব ডিলান। কমিটির কাছে লেখা একটি চিঠিতে শুধু আসতে না পারার কথা জানিয়ে ছিলেন তিনি।
না হয় না-ই দেখলাম তাঁকে। তাই বলে কি তাঁর প্রতি ভালোবাসা কমে যাবে? আমরা তো আগেই শুনেছি তাঁর সেই গান ‘ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড’। কবির সুমনের কণ্ঠে ‘কতটা পথ পেরুলে তবে পথিক বলা যায়’ গানটি যে বব ডিলানের সেই বিখ্যাত গানেরই অন্তরাত্মা, সে কথাও তো আমরা জেনে গেছি তত দিনে। ‘দ্য টাইম দে আর এ চেঞ্জইন’ গানটিতে হঠাৎ হারমোনিকায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি আমরা। ‘ব্রিংগিং ইট অল ব্যাক হোম’ উঠে এসেছে পছন্দের তালিকায়। জেনে গেছি, মানুষটি কথা বলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে গানে গানে। কখন যে তাঁর গানে ঢুকে পড়ে রাজনীতি, কখন দর্শন, সে কথাও কি আর মনে রাখা যায়। তবে সে সময় আমরা বুঝতে শিখে গেছি, এই মানুষ শুধু আনন্দ দেওয়ার জন্য গান করেন না। তাঁর গানে থাকে সামাজিক চেতনার বীজ।
লোকসংগীত
হারিয়ে যাচ্ছিল আমেরিকার লোকসংগীত। সেটাই উদ্ধার করার জন্য সচেতনভাবে বব ডিলান এসেছিলেন গান করতে। আমাদের মনে পড়ে যাবে, আমরা যখন শুনতে থাকি ভিয়েতনামের যুদ্ধের সময় কিংবা মার্টিন লুথারের মিছিলে হারমোনিকা মুখে আর গিটার হাতে ববের উদ্দাম ছুটে চলার খবর, তখন জেনে যাই মানবতার পক্ষে বেজে চলেছে এই মানুষটির অন্তরাত্মা। যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন তিনি। দাসপ্রথার গল্প বলেছেন শ্লেষের সঙ্গে। অস্থিরতার সময় তরুণ-যুবকেরা যেন ডিলানের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন নিজেদের।
জিবেরম্যানকে চেনেন আপনারা?
রবার্ট অ্যালেন জিবেরম্যান নামে কাউকে চেনেন আপনারা? যে বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা গেলেন, সেই ১৯৪১ সালে জন্ম এই লোকের। না, জিবেরম্যান নামে তাঁকে চেনা যাবে না। আমরা চিনব বব ডিলান নামেই, কিন্তু তার আগে জেনে নেব যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে ববের দাদা-দাদি থাকতেন রাশিয়ায়। ১৯০৫ সালে যে ব্যর্থ অভ্যুত্থান হয়েছিল, তার জের ধরেই জারের রাশিয়া থেকে চলে এসেছিলেন আমেরিকায় ববের দাদা-দাদি। উপায় তো ছিল না। সে সময় বিপ্লবের যে কথা শোনাচ্ছিলেন রাজনীতিকেরা, যা কঠোর হাতে দমন করেছিলেন জার। ফলে অনেককেই মেনে নিতে হয়েছিল দেশ ত্যাগের কাঠিন্য। রুশ সাম্রাজ্যের ইউক্রেনের ওদেসায় ছিল তাঁদের বাড়ি। এবার ঠাঁই হলো যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায়। ববের ছয় বছর বয়সে পোলিও আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন ববের বাবা। বাধ্য হয়ে মা চলে এলেন বাপের বাড়ি হিবিংয়ে। সেখানেই রবার্ট মানে ববের বেড়ে ওঠা। বব যেন সেখানে হয়ে উঠলেন প্রকৃতির সন্তান। সেই সঙ্গে সুযোগ পেলেই তিনি শুনতেন রেডিওর গান। হ্যাঁ, তখন তাঁর প্রিয় ছিল ব্লুজ আর কান্ট্রি সং। এগুলো শুনতে শুনতে, বুঝতে বুঝতেই রক-এন রোলের ভক্ত হয়ে উঠলেন বব। হিবিংয়ে স্কুলে থাকতেই বব গড়ে তুলেছিলেন একটা ব্যান্ড। ভাবা যায়?
মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন ১৯৫৯ সালে। তখন কিন্তু রক গানের প্রতি ঝোঁকটা আর টিকল না। তিনি ঝুঁকলেন লোকসংগীতের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয় ভালো লাগল না তাঁর। চলে এলেন নিউইয়র্কে। রবার্ট অ্যালেন জিবেরম্যান তাঁর নাম পাল্টালেন। তিনি ছিলেন কবি ডিলান টমাসের ভক্ত। তাই নিজের নাম দিলেন বব ডিলান। বব ডিলান হয়ে ওঠার রহস্য এটাই।
বিটলসের সঙ্গে কথোপকথন
১৯৫২ সালে আমাদের দেশে যখন ভাষা আন্দোলন চলছে, সে সময়ই আমেরিকা পরিচিত হলো নতুন এক লোকসংগীতশিল্পীর সঙ্গে। আমেরিকা এরপর দেখবে এই লোকসংগীতশিল্পীর গীতিকার হয়ে ওঠার দৃশ্য। দেখবে সাম্যের প্রতি অবিচল আস্থা নিয়ে পথচলা এক নতুন গায়ককে।
ইংরেজি গানের কথা এলেই আমাদের অনেকেই বিটলসের কথা বলতে শুরু করি। তার আগে এলভিস প্রিসলিও মন রাঙিয়ে যান। তবে লিভারপুলের এই ছোকরা চতুষ্টয় ষাটের দশকে যখন ইংল্যান্ড মাতিয়ে সারা বিশ্বের সংগীতপিপাসু তরুণদের উন্মাদনার কেন্দ্রে এসে উপস্থিত হলন, তখনো বব তাঁর রাজত্ব চালাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৬৪ সালেই ‘আই ওয়ান্ট টু হোল্ড ইওর হ্যান্ড’ অ্যালবামের মাধ্যমে সারা বিশ্ব তখন বিটলসের খোলা কনসার্টের জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠল। বাদ গেল না নিউইয়র্ক। সে বছরই নিউইয়র্কের ম্যানহাটন দেখল বিটলস-চমক। দর্শকের আসনে ছিলেন বব ডিলান। কনসার্ট শেষে ববের সঙ্গে দেখা হলো বিটলসের সদস্যদের। সেখানে বাতচিৎ হলো। ডিলান এই সদ্য কৈশরোত্তীর্ণ চার তরুণকে বোঝালেন গান দিয়ে শুধু হৃদয় মাতালেই হবে না, তাতে থাকতে হবে রাজনীতিক ও সামাজিক সচেতনতা। গান দিয়ে করতে হবে প্রতিবাদ। লেনন, ম্যাককার্টনি, জর্জ হ্যারিসন, রিংগো স্টারেরা তাঁর কথা শুনল কিছুটা, কিছুটা শুনল না। কিন্তু ডিলানের ভাষ্যকে অগ্রাহ্য করতে পারেননি তাঁরা। আমরা দেখতে পাব, ডিলানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই একটু একটু করে বদলে যাচ্ছিল বিটলসের গান।
ডিলান চললেন নিজের পথ ধরে
নতুন ধরনের ফোক-রক-পপ মিলেমিশে একাকার হলো ডিলানের গানে। এরই মধ্যে এল ১৯৭১। এ কথা এখন আর কারও অজানা নয়, পণ্ডিত রবি শঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসন মিলে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে যে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর আয়োজন করেছিলেন, তাতে অংশ নিয়েছিলেন বব ডিলান। পাঁচটি গান করেছিলেন তিনি। শেষ গানটিতে জর্জ হ্যারিসন আর লিওন রাসেলও কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন। সেদিন অ্যাকুস্টিক গিটার ও হারমোনিকা ছিল ডিলানের সঙ্গী।
নোবেল এবং ডিলান
অনেকের মনেই প্রশ্ন ছিল, একজন গায়ক কীভাবে পান নোবেল সাহিত্য পুরস্কার। পুরস্কারটা যে গায়ক ডিলান পাননি, পেয়েছেন রচয়িতা ডিলান, সেটা বুঝতে সময় লেগেছে অনেকের। নোবেল পাওয়ার আগে থেকেই ডিলান ছিলেন প্রিয় গায়কের তালিকায়। তাঁর ও জোন বায়েজের কথাও ঘুরেছে মুখে মুখে। নোবেল নিতে গেলেনই না। পরে গ্রহণ করলেন। নোবেল কমিটিকে লিখলেন এক ঐতিহাসিক চিঠি।
অনেকেই বব ডিলান আর লিওনার্দ কোহেনের কথা ব্র্যাকেটবন্দী করে মনে রাখেন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে তাঁরা দুজন সংগীতের এক নতুন ধরন নিয়ে হাজির হন। এরপর এগিয়েছেন আরও অনেকটা পথ। কোহেনের পথ চলা থেমে গেছে। চলছেন ডিলান। এখনো গানে গানে তাঁকে আমরা পাচ্ছি, এ বড় আনন্দ আমাদের।