'আমার অনেক প্রথমের সঙ্গে রয়েছেন তাজিন আহমেদ'
১৯৯৬ সালের শেষ দিকের কথা। ভোরের কাগজ–এ লেখালেখির সূত্র ধরে তাজিন আহমেদের সঙ্গে পরিচয়। প্রথম দিন থেকেই তাজিন আহমেদ হলেন তাজিন আপা। শুধু নামের আপা না। সত্যিকারের বোন যেন। অনেক আগে বিটিভিতে একটা ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হতো ইতি আমার বোন। ওই নাটকের শিরোনামের মতো আমিও নির্ধিদ্বায় বলতে পারি তাজিন আমার বোন।
আমার তাজিন আপা দর্শকদের কাছে তাজিন আহমেদ হলেন তৌকীর আহমেদের সঙ্গে একটা নাটক প্রচারের পর। নাটকটার নাম ছিল শেষ দেখা শেষ নয়। সে সময়ের ডাকসাইটে বিনোদন পাক্ষিক আনন্দধারা তখন তাঁকে নিয়ে একটা প্রতিবেদনও ছাপল। এরপর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
একের পর এক নাটকের কাজ তাঁর হাতে আসতে লাগল। সেই সঙ্গে প্রচুর বিজ্ঞাপনের কাজ। কিন্তু অদ্ভুত বিষয়, তাজিন সবিনয়ে বিজ্ঞাপনের কাজগুলো ফিরিয়ে দিতেন। তাঁর কথা ছিল, নাটক ও বিজ্ঞাপন দুটো কাজ একসঙ্গে করতে গেলে কোনোটাই ভালো হবে না। আর আমি নাটকের মানুষ হতে চাই, তাই বিজ্ঞাপনে আগ্রহ নেই।
বিজ্ঞাপনের কাজ ফিরিয়ে দিলেও নাটকের পাশাপাশি আরেকটা কাজ করতেন তাজিন আপা। ভয়েস দেওয়া, মানে কণ্ঠশিল্পীর কাজ। কাজটি তখন তিনি করতেন। তবে এটা থেকে যে আয় হতো, তার পুরোটাই যেত আমাদের পেটে।
ব্যক্তি তাজিন ভীষণ হাতখোলা ছিলেন। দেদার খরচ করতেন। তাঁর আশপাশের কারও বিপদ হয়েছে, তাজিন এগিয়ে আসেননি, এ খবর আমার জানা নেই।
টিভিতে নাটক করতে করতে তাজিন যোগ দিলেন মঞ্চে। অভিনয়শিল্পীদের মূল জায়গা তো মঞ্চই। ‘নাট্যজন’ দলে কাজ করতেন। তাঁর প্রথম মঞ্চনাটক ছিল ঘৃতৎ পিবেৎ। বলার অপেক্ষা রাখে না, দর্শক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল নাটকটি। তাঁর অভিনয়ও প্রশংসিত হয়েছিল। তাঁর অভিনয়প্রতিভা এতই দ্যুতি ছড়িয়েছিল, সে সময় প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর একটি ধারাবাহিক ভূতের নাটক নীলচুড়ির মূল নায়িকার চরিত্রের জন্য তাজিনকে পছন্দ করেছিলেন।
তাজিন টিভি নাটকে একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন, এ তথ্য সবার জানা। তবে কোনো কিছুই তো স্থায়ী না। তাঁরও ভাটা পড়ল। তার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, তবে একটা বড় কারণ হলো, তাজিন আহমেদের ভেতরের তীব্র অভিমান। এরও অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রথম আলোয় নিয়মিত লেখালেখিটা।
এই অভিমানের কারণে অনেক হারাতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর কাছের মানুষেরা ভুল বুঝেছেন। সরে গেছেন দূরে। এ তালিকায় নাট্যনির্মাতা থেকে শুরু করে পরিবারের সদস্য সবাই আছেন। যেকোনো অন্যায়–অন্যায্য কাজের প্রতিবাদে আবেগের চূড়ান্ত ঢেলে দেওয়াটা তাঁর স্বভাব ছিল। আর তাজিন আহমেদের ছিল একট শিশুতোষ ধারণা, সবাই তাঁকে বুঝবে। বুঝেছে ঠিকই তবে ভুল বুঝেছে, এই যা।
শিল্পীদের এমনিতেই অনুভূতির দিকগুলো প্রখর হয়। তবে তাজিন এ পৃথিবীর কঠিন রূপ বুঝতেন না। সবকিছুই তাঁর আবেগ–অনুভূতি দিয়ে পরিমাপ করতেন। আর এভাবে খামখেয়ালিপনায় একপর্যায়ে তাঁর খারাপ সময়ের শুরু হলো।
>শিল্পীদের এমনিতেই অনুভূতির দিকগুলো প্রখর হয়। তবে তাজিন এ পৃথিবীর কঠিন রূপ বুঝতেন না। সবকিছুই তাঁর আবেগ–অনুভূতি দিয়ে পরিমাপ করতেন। আর এভাবে খামখেয়ালিপনায় একপর্যায়ে তাঁর খারাপ সময়ের শুরু হলো। পেশা, পরিবার ও অর্থনৈতিক দুঃসময়—সব একসঙ্গে। দুঃসময় এলে দুধের মাছিরা পালায়, সেটা তো পরীক্ষিত সত্য, তাজিনের খারাপ সময়েও অনেকেই পালাল।
পেশা, পরিবার ও অর্থনৈতিক দুঃসময়—সব একসঙ্গে। দুঃসময় এলে দুধের মাছিরা পালায়, সেটা তো পরীক্ষিত সত্য, তাজিনের খারপ সময়েও অনেকেই পালাল। ঢালাওভাবে সবার কথা বলা যাবে না, কেউ কেউ পাশেও দাঁড়াল, তবে সেই সংখ্যা নেহাত নগণ্য।
তাজিন আহমেদ একটা মৃত তারার নাম। তবে মৃত্যুর আগে তাঁর নামের পাশে ‘খসে পড়া’ তকমাটা লেগে গিয়েছিল। এর জন্য কার দায় কতটুকু, সে হিসাব করাটাই এখন বাতুলতা।
আমার জীবনের অনেক প্রথমের সঙ্গে তাজিন আহমেদের নাম জড়িয়ে। প্রথম অভিনয় থেকে শুরু করে শুটিং ইউনিটের প্রথম খাবারের স্বাদ নেওয়া—সবকিছুতেই তাঁর নাম।
যেকোনো স্মৃতিচারণামূলক লেখার শেষে, ‘ওপারে তিনি ভালো থাকুন’ এমন কামনা বাক্য লেখাটা নিয়ম। তবে তাজিনের ক্ষেত্রে এসব লেখার কোনো প্রয়োজন মনে করছি না। কারণ আপাদমস্তক ভালো মানুষদের স্রষ্টা ভালোই রাখেন।
লেখক: অভিনেতা