কোনো ঘোষণা বা আনুষ্ঠানিকতা নয়, ঘড়ির কাঁটায় ঠিক ৭টায় শুরু হয়ে গেল নাটক। হুইলচেয়ারে বসে এলেন এক প্রবীণ। নাম তাঁর বিকাশ। গান গাইতে গাইতে ঢোকেন। মঞ্চের ঠিক মাঝখানে থামলেন বিকাশ। কবিতার মতো বলে চললেন সংলাপ, ‘আমরা তিনজন। আমি, অসিত আর হিতাংশু; ঢাকায় পুরানা পল্টনে, উনিশ-শ সাতাশে। এক পাড়ায় থাকতাম তিনজন। পুরানা পল্টনে প্রথম বাড়ি উঠেছিল তারা-কুটির, সেটা হিতাংশুদের...।’
গত ৩০ এপ্রিল জাতীয় নাট্যশালায় দর্শক তখন মগ্ন বুদ্ধদেব বসুতে। মঞ্চে তাঁর লেখা গল্প ‘আমরা তিনজন’–এর দৃশ্যকাব্য। সেটা দেখতে সুবিশাল মিলনায়তনের প্রতিটি আসন পূর্ণ। এদিন ছিল নাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনী। সেদিন মিলনায়তনের বাইরের লম্বা লাইনই জানান দিয়েছে নতুন নাটক নিয়ে মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা, কৌতূহল এখনো তুঙ্গে।
অল্প কয়েকটি চরিত্র নাটকে। বিকাশ, অসিত, হিতাংশু, অন্তরা, দে সাহেব, সুমি, হীরেন বাবু এবং ভৃত্য। এ চরিত্রগুলো মঞ্চে পরিবেশন করেছেন লিয়াকত আলী লাকী, মাস্উদ সুমন, ফজলুল হক, আজিজুর রহমান, অনন্যা নীশি, স্বদেশ রঞ্জন দাসগুপ্ত, সোনিয়া আক্তার, জিয়া উদ্দিন, শিশির কুমার রায়।
১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটের নাটক। আক্ষরিক অর্থে সারাক্ষণই পিনপতন নীরবতা ছিল মিলনায়তনে। লিখলে মোটেও বাড়াবাড়ি হবে না, দর্শক বেশ মনোযোগ দিয়েই নাটকটি দেখেছেন। অবশ্য মন না দিয়ে দেখার উপায়ও নেই। সংলাপগুলো কবিতার মতো। গল্পটা নস্টালজিয়ায় ভরা। কাব্যনাটক নয় ঠিকই, তবে এ নাটকের সংলাপগুলো উঁচুমানের এক কাব্যভাষায়। সে ভাষা ছন্দময় ও অলংকারসমৃদ্ধ। প্রতিটি সংলাপ যেন একেকটা সার্বভৌম কবিতা।
বলে নেওয়া ভালো, বুদ্ধদেব বসুর গল্পের সংলাপগুলোই হুবহু ছিল নাটকে। মূলত লেখা হয়েছে ১৯২৭ সালে ঢাকার পুরানা পল্টনকে ঘিরে। যেখানে বিকাশ, অসিত ও হিতাংশু তিন বন্ধু। দিনের বেশির ভাগ সময় তিন বন্ধু একসঙ্গে থাকেন, যতটা এবং যতক্ষণ থাকা সম্ভব। তিন বন্ধু একসঙ্গে অন্য একজনের প্রেমে পড়ল। অন্তরা নামের মেয়েটিকে ঘিরেই সারাক্ষণ তিন বন্ধুর নানা রকম জল্পনা-কল্পনা। মূলত হুইলচেয়ারে বসে বর্তমান সময়ের প্রবীণ বিকাশ ১৯২৭ সালের স্মৃতিচারণা করছেন।
নাটকের বিকাশরা যখন তরুণ, তখন তাঁরা মেয়েটির নাম দেন মোনালিসা। নাটকের শেষ দিকে দর্শকের মন খারাপ হতে দেখা যায়। এক রাতে প্রসববেদনায় ছটফট করতে করতে মারা যান মোনালিসা। শেষ দৃশ্যে আবার ফিরে আসেন প্রবীণ বিকাশ, হুইলচেয়ারে। হুইলচেয়ারে পরাজিত যোদ্ধার মতো চলতে চলতে বিকাশ বলে ওঠে, ‘আমি এখনো আছি, ঢাকায় নয়, পুরানা পল্টনে নয়, ১৯২৭–এ কি ২৮–এ নয়, সে-সব আজ মনে হয় স্বপ্নের মতো, কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু স্বপ্ন, ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে একটু হাওয়া—সেই মেঘে-ঢাকা সকাল, মেঘে-ডাকা দুপুর, সেই বৃষ্টি, সেই রাত্রি, সেই—তুমি! মোনালিসা, আমি ছাড়া আর কে তোমাকে মনে রেখেছে!’
নাটক দেখে মনে হয়েছে, বুদ্ধদেব বসুর লেখনীর সেই আমেজকে একদম ঠিকঠাক ধরতে পেরেছেন নির্দেশক। নাটকের আঙ্গিক, অভিনয়, আবহ, আলোয় মূল গল্পের মেজাজ প্রায় দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। এখানেই নাটকটির বড় সাফল্য।
অভিনয়ে সবার আগে বলতে হয় তরুণ বয়সের ‘বিকাশ’ অর্থাৎ মাসউদ সুমন এবং প্রবীণ বয়সের ‘বিকাশ’–এর ভূমিকায় লিয়াকত আলীর কথা। চরিত্রটিকে তাঁরা জীবন্ত করে তুলেছেন। তবে তরুণ বিকাশের সঙ্গে প্রবীণ বিকাশকে কোনোভাবেই মেলাতে পারেননি দর্শক। প্রবীণ হলে মানুষ এত বদলে যায়! ভৃত্য চরিত্রে শিশির কুমার রায়কে দেখে তো একজন দর্শক বলেই ফেললেন, ‘আরে একে পেল কোথায়? একেবারেই পুরোনো সাদাকালো বাংলা সিনেমায় দেখা সেই সব ভৃত্য মনে হচ্ছে।’ অন্তরা চরিত্রে অনন্যা নীশির কথা না বললে অপরাধ হবে। তিনিই তো নাটকের মূল চরিত্র। তাঁর সংলাপ খুব কম হলেও মঞ্চে দীর্ঘক্ষণ দেখা গেছে, সারাক্ষণ সাবলীল ছিলেন। সংলাপ ছাড়াও দর্শকের যথেষ্ট মনোযোগও কেড়েছেন।
এই ধরনের নাটকে, যেটা অতীতের কোনো সময়ের গল্পের আশ্রয়ে করা, তাতে আলো আর আবহর একটা বড় ভূমিকা থাকে। এই দুই ক্ষেত্রে নাসিরুল হক এবং ইমামুর রশীদের কাজ প্রশংসাযোগ্য। পোশাক পরিকল্পনায় মেহেজাবীন মুমু যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন ১৯২৭ সালের ওই সময়ে ঢাকা এবং কলকাতার স্টাইলটাকে তুলে ধরতে। তবে নাটকের মেকআপ আরও একটু ভালো হতে পারত, এমন কথা কয়েকজন দর্শকের কাছে শোনা
গেছে। তাঁদের কাছে কখনো কখনো মেকআপ কিছুটা অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। আবার এমনও বলেছেন দর্শক, নাটকের সময়কাল আরেকটু ছোট করলে বেশি ভালো লাগত। হয়তো নির্দেশক ভবিষ্যতে এসব নিয়েও ভাববেন।