প্রয়াণের ৯ মাস আগে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল রাত ৪টায় দিনলিপি লিখতে বসেছিলেন সেলিম আল দীন। তার মাসখানেক আগে সম্পন্ন করা একটি নাটক নিয়ে লিখেছিলেন, ‘আমি পুত্র বলে যে নাটকটি লিখেছি, তা প্রায় কালবৈশাখীকে কলমে ভরে। নইলে একটানা ছিয়ানব্বই ঘণ্টা লেখার গতিটা পেলাম কী করে।’
সেলিম আল দীন চলে যাওয়ার প্রায় ১২ বছর পর পুত্র নাটকটি মঞ্চে এনেছে ঢাকা থিয়েটার। নির্দেশনা দিয়েছেন সেলিমের বহু নাটকের প্রধান অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফ। যে ঝোড়ো মেজাজ এ নাটকের বুক চিরে অন্তঃসলিলের মতো বইছে, তার হদিস বুঝি সকলের নাগালে নেই। বুকে পাথরচাপা দিয়ে যে হাহারবকে কালি ও কলমে ধরতে চেয়েছিলেন নাট্যকার, যে কৃৎকৌশলে ব্যক্তিগত শোকের দুনিয়াকে হাট করে খুলে দিয়েছিলেন সহমর্মীদের জন্যে, তাঁকে প্রসেনিয়ামের খোপে ফেলা যেমন কঠিন, তার চেয়ে ঢের কঠিন তাঁকে রসিকজনের দরবারে পৌঁছে দেওয়া। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় এ নাটকের প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল। চতুর্থটি হলো ওরই লাগোয়া কিন্তু আরেকটু আঁটোসাঁটো এক্সপিরিমেন্টাল থিয়েটারে। গত ১৮ জানুয়ারি। ৭০ মিনিটের এই নাটক ভাঙার পর বিহ্বল হয়ে বসে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর মধ্যেও এক মহত্ব আছে। বিয়োগান্ত নাটক দেখতে দেখতে তীব্র অন্তর্দাহের পর যে আত্মমোক্ষণ একদা গ্রিক নগররাষ্ট্রের শাসককুলের খুব কাঙ্ক্ষিত মনে হতো, ঢাকা থিয়েটারের পুত্র কতক সেই উচ্চতায় নিজেকে স্থাপন করেছে। তফাত এই যে যার জন্য বা যাদের জন্য এমন বিহ্বলতা, তারা কেউ রাজাবাদশা নয়, তারা সারা গায়ে মাটি–জল মাখা মেহনতি মজদুর, যাদের আনখশির এই বাংলাদেশের লোহিত অস্থিমজ্জায় মিলেমিশে আছে। এ মাটির বুকের ভেতর নদীর কলিজার ভেতর যে বিরোধাভাস বোনা আছে, যমুনার ধু ধু চরের এপার–ওপারের মধ্যে আছে যে দুস্তর ব্যবধান, শ্রমজীবী মানুষের রণ-রক্ত-ভালোবাসায় মোড়ানো আছে যে নিবিড় নিঃসঙ্গতা, এ নাটক তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। যে আদিম আঁধার ঘিরে ছিল পদ্মা নদীর মাঝিকে, তিতাস একটি নদীর নাম যে বিলীয়মান কৌমচেতনার জলছবি এঁকেছিল, পুত্র সেই ধারাবাহিকতায় বাঁধা। ফারাক তার অন্তর্লীন গাঢ় বিষণ্নতায়।
কীসের বিষণ্নতা? যমুনাপাড়ের মাইট্যাল দম্পতি সিরাজ আর আবছা। তাদের একমাত্র সন্তান মানিক মনের মতো করে ঘুড়ি ওড়াতে পারেনি বলে মনের দুঃখে গলায় দড়ি দিয়ে আমগাছ থেকে ঝুলে পড়েছিল। জানাজা অবধি করা যায়নি তার। তারপর কত দিন কেটে গেছে। পুত্রশোক কুরে কুরে খেয়েছে মাইট্যাল দম্পতিকে। হারানো ছেলের জায়গা নিয়েছে ওই ঘাতক আমগাছ। অপয়া বলে সেই গাছটিকে যখন কেটে ফেলা হলো, যখন শীতের রাতে ওম পোয়ানোর জন্য ওই আগুন ধরানো হলো সেই সব শিকড়বাকড়ে, তখন বিষাদসিন্ধুতে যেন জোয়ার এল ফিরে। ধিকধিক করে জ্বলে উঠল ছেলেহারা আবছার মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা। একুশ বছর ঘর করার পর সিরাজকে তালাক দিয়ে ‘আরেক দিঘল, আরেক আসমানের তারা ছোঁয়া মানুষের খোঁজ’ করতে, যে তাকে ‘গাঙের ভাঙনের কিনারে দাঁড় করায়ে ফের টাইনা তুলব’, তার ‘অপয়ার অপবাদ ঘুচায়ে সুপয়ার সুনাম দিব’, সেই পুরুষের জন্যে বেরিয়ে পড়ল আবছা।
নারীর যৌনতৃপ্তি ও মাতৃত্বসুখের এমন যুগপৎ উদ্যাপন সেলিমের নাটকে আর নেই। যে পিতৃতান্ত্রিকতা তাঁর রচনার কবচকুণ্ডল, পুত্র লিখতে বসে যেন তা–ও খুলে রেখেছিলেন তিনি। নাটক সম্পাদনা করতে বসে এর দোহারা চেহারাকে অটুট রেখেছেন নির্দেশক। সেলিমের রেখে যাওয়া পাঠকে ভেঙেচুরে, নাটকীয় কালখণ্ডকে আগুপিছু করে ছেঁটেকেটে, তাকে সুরে–তালে হেলিয়ে–দুলিয়ে এমন একটি পারফরম্যান্স টেক্সট গড়েছেন শিমূল ইউসুফ, কুড়ি বছরের সম্পর্কের জোয়ার–ভাটা দিব্যি খেলেছে তাতে। তা বলে সিধে রাস্তা কাটার বান্দা তিনি নন। বর্ণনার (রফিকুল ইসলাম) ভাগ কিঞ্চিৎ কমিয়ে ডাবল কাস্টিংয়ের নিপুণ প্রয়োগে সিরাজ (আসাদুজ্জামান আমান ও সাজ্জাদ আহমেদ রাজীব) আর আবছার (এশা ইউসুফ ও সামিউন জাহান দোলা) আপাতনিস্তরঙ্গ জীবনের ভেতরকার তরঙ্গবিক্ষোভকে সামনে এনেছেন শিমূল। কখনো সমান্তরালে বয়ে চলেছে দুই সিরাজ দুই আবছার কিসসা–কাহিনি। কখনো এক সিরাজের দীর্ঘশ্বাসের দোহারকি দিয়েছে আরেক সিরাজ। এক আবছার অসম্মান ফুটেছে আরেক আবছার চোখেমুখে। মাঝেমধ্যে যখন ঘন হয়ে নেমেছে বিষাদ, তখন কথা ও সুরের জাল বুনে আমাদের হাঁফ ছাড়ার জানলা খুলেছেন সাকি ব্যানার্জি। সংলাপ ছন্দে বাঁধা। চটপট বলতে গিয়ে জিভে না জড়ালেও ভাবের আদান–প্রদানে ঘাটতি পড়েছে মাঝেমধ্যে। মর্মে পশেনি অনেক উচ্চারণ। দু–একজন তরুণ কুশীলবকে তো বেশ নড়বড়ে লেগেছে।
তবে এ মঞ্চায়নের তুরুপের তাস তার দৃশ্যবৈভব। জাগতিক বাস্তব নয়, তার টেক্কা হয়েছে পরাবাস্তবের আন্দাজ। মঞ্চসামগ্রী বলতে কয়েকটি জলচৌকি, পর্দা আর শিকড়বাকড়। সব সাদা—কুশীলবদের জামাকাপড়ের রঙের সঙ্গে খাপসই। চিত্রকর ঢালী আল মামুনের শিল্পনির্দেশনায় ওই শিকড় হয়ে উঠেছে নদীবিধৌত বাংলার মরণ–বাঁচনের প্রতীক। নাসিরুল হক খোকনের আলোতে এক আধিভৌতিক আভা ফুটেছে। আর আমাদের চমকে দিয়ে নাটক শুরু হতেই হাড়ভাঙা খাটুনির শরীরী ভাস্কর্যের মধ্যে মিশে গেছে সুফিয়ানা কলমের অঙ্গবিভঙ্গ। মঞ্চের পেছন দিয়ে আড়াআড়ি হেঁটে গেছে অলীক ছায়ামূর্তি। খোয়াবনামার আভাস দিয়ে। মঞ্চের মাঝবরাবর কাপড়ের মতো ঝুলেছে মরদেহ। উল্টোনো কবর উঠে গেছে মহাশূন্যের দিকে। অথচ কোথাও তেলেজলে হয়নি। অভ্রান্ত নিশানায় চিনে চিনে গেছে অপত্যস্নেহ শোক আর উত্তরণের অসংখ্য দিগন্তে। এই অনেকান্ত অনুভব ঢাকা থিয়েটারের ৪৭তম প্রযোজনার পরম প্রাপ্তি।