নেটফ্লিক্স ঠেকাতে স্পিলবার্গ!
স্টিভেন স্পিলবার্গ। এই ব্যক্তিকে চেনাতে তাঁর তৈরি হাজারটা সিনেমার নাম শোনাতে হয় না। শিশু থেকে বুড়ো—সব বয়সী দর্শকদের কাছেই সমান জনপ্রিয় হলিউডের এই জীবন্ত কিংবদন্তি। একদিকে যেমন বক্স অফিস কাঁপানো ছবি তৈরি করেছেন, অন্যদিকে অস্কার জেতা ছবিও আছে তাঁর ঝুলিতে। স্পিলবার্গ এবার নেটফ্লিক্সের ছবির অস্কার জেতার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই নিয়ে এখন পক্ষে-বিপক্ষে বাদানুবাদ তুঙ্গে। কিন্তু আদৌ কি নেটফ্লিক্সের বাড়া ভাতে ছাই দিতে পারবেন স্পিলবার্গ?
তোলপাড় শুরু হয়েছে গত মাসের অস্কার পুরস্কার বিতরণীর পরপরই। এবারের ৯১তম আসরে মোট ১০টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিল নেটফ্লিক্সের ছবি ‘রোমা’। এবারই প্রথম অস্কারে মনোনয়ন পায় নেটফ্লিক্সের কোনো ছবি। শেষে তিনটি বিভাগে সোনালি ট্রফিও জিতে নিয়েছে ‘রোমা’। এর কয়েক দিন পরই বোমা ফাটান স্টিভেন স্পিলবার্গ। তিনি বলেন, ‘রোমা’র মতো ছবিকে অস্কার দেওয়া উচিত নয়। এই ছবি হয়তো এমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হতে পারে, কিন্তু অস্কারের মঞ্চ এর জন্য নয়। তাঁর মতে, সিনেমা হলে মুক্তি না পাওয়া বা সীমিত আকারে মুক্তি পাওয়া এসব ছবি অস্কার পেতে পারে না। এগুলো যেহেতু অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইটে মুক্তি পাচ্ছে, সেহেতু এগুলো টিভি প্রোগ্রামের সমান। কারণ এগুলো দর্শকদের সিনেমা হলে বসে ছবি দেখার অভিজ্ঞতা দিচ্ছে না। তাই ‘রোমা’-কে পরিপূর্ণ ছবির মর্যাদা দিতে রাজি নন স্পিলবার্গ। তাঁর মতে, অস্কারে মনোনীত হওয়ার জন্য একটি ছবিকে পরিপূর্ণভাবে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিতে হবে এবং ন্যূনতম ৪ সপ্তাহ সেখানেই দেখাতে হবে।
এই কথাতেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে নেটফ্লিক্স কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি এক বিবৃতিতে নেটফ্লিক্স বলেছে, তারা সিনেমা ভালোবাসে এবং যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ সিনেমা হল বা প্রেক্ষাগৃহের অভাবে ছবি দেখতে পান না, তাঁদের জন্যই অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের এই প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নিজেদের ‘জনপ্রিয়’ বলেও অভিহিত করেছে নেটফ্লিক্স। স্পিলবার্গের কথার পাল্টা জবাব দিলেও বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটি এই বরেণ্য পরিচালকের নামটি উচ্চারণও করেনি। অনেকে বলছেন, কথার লড়াইকে ‘সম্মুখ সমরে’ রূপ দিতে চায়নি এই প্রতিষ্ঠান। তাই এই সাবধানতা এবং এর কারণও স্পষ্ট।
হলিউডে স্টিভেন স্পিলবার্গের প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রশ্নাতীত। অস্কার পুরস্কার দেয় যে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস কর্তৃপক্ষ, সেখানকার বোর্ড সদস্য স্পিলবার্গ। অস্কারে মনোনয়ন পাওয়ার শর্তাবলি নিয়ে কাজ করছেন তিনি। সামনেই এ-সংক্রান্ত একটি বৈঠকে তিনি সুপারিশ পেশ করবেন। ধারণা করা হচ্ছে, অস্কারের মনোনয়ন পাওয়ার শর্তাবলি কিছুটা কঠোর করার কথাই বলবেন ‘ইটি’ পরিচালক। বর্তমানে অস্কারে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য যেকোনো ছবিকে ন্যূনতম এক সপ্তাহ প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ‘রোমা’ প্রেক্ষাগৃহে ছিল মোটে তিন সপ্তাহ এবং তা-ও হাতে গোনা কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে এটি দেখানো হয়েছিল। এ নিয়ে আগে থেকেই কথা উঠেছিল। বলা হচ্ছে, নেটফ্লিক্স ইচ্ছে করেই এই কৌশল নিয়েছিল। কারণ নেটফ্লিক্সের মূল ব্যবসা অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিংয়ে, সেখানেই তাদের অসংখ্য গ্রাহক। এখন যদি ছবিগুলো প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়, তবে ওই ব্যবসা মার খেয়ে যাবে। শুধু অস্কারের শর্ত পূরণ করতেই তাই প্রেক্ষাগৃহে সীমিত মুক্তির আয়োজন করেছিল নেটফ্লিক্স।
স্পিলবার্গের আপত্তি এই জায়গাতেই। তাঁর কথায়, নেটফ্লিক্সের ছবিগুলো ছোট পর্দার জন্য তৈরি করা হয় এবং এতে পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবির স্বাদ নেই। কারণ এগুলো প্রেক্ষাগৃহে ব্যাপক আকারে প্রদর্শন করা হয় না। সুতরাং বড় বড় প্রযোজনা সংস্থার তৈরি ছবির তুলনায় আসতে পারে না নেটফ্লিক্সের ছবি।
আরেকটি সমস্যাও আছে। নেটফ্লিক্স তাদের ছবি যখন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে নিজেদের ওয়েবসাইটেও মুক্তি দিচ্ছে। এখন একজন দর্শক যদি নিজের ড্রইংরুমে বসেই একটি সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবি উপভোগের সুযোগ পান, তবে কি তিনি কষ্ট করে প্রেক্ষাগৃহে যাবেন? আর দর্শক ভিড় না জমালে প্রেক্ষাগৃহের ব্যবসা হবে কী করে?
অবশ্য স্পিলবার্গের সমালোচকেরা বলছেন, শিল্পকে এভাবে প্রেক্ষাগৃহ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। নেটফ্লিক্সের ছবি শিল্পমান ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে উন্নত কি না, সেটিই বিবেচ্য হওয়া উচিত। শুধু প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয় না বলে একে অস্কারের মঞ্চ থেকে বের করে দেওয়া যায় না। আর অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের যে নতুন চল বিশ্বে শুরু হয়েছে, তাকে এভাবে ধরে-বেঁধেও রাখা যাবে না।
একটি বিষয় ঠিক যে, নেটফ্লিক্স পুরো বিশ্বের বিনোদন মাধ্যমের ধরন বদলে দিয়েছে। নেটফ্লিক্সের দেখানো পথে হেঁটে এখন অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের ব্যবসায় নাম লেখাচ্ছে ডিজনি, এটিঅ্যান্ডটি, ওয়ার্নার মিডিয়া, এইচবিও, আমাজনের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান। এই ব্যবসায় শুধু কনটেন্ট বানানোতেই প্রতিবছর ১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করে নেটফ্লিক্স। বিশ্বব্যাপী যে নতুন ব্যবসায়িক পদ্ধতিতে ছবি ও সিরিজ পরিবেশনার কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি, সেটি একটি ‘মানি মেশিনে’ পরিণত হয়েছে। এই যন্ত্রকে হুট করে বন্ধ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে দর্শকদের ছবি দেখার নতুন অভ্যাসটিও মাথায় রাখতে হবে। এখন মানুষ ঘরে বসেই বিশ্বমানের সিনেমা ও সিরিজ নির্ঝঞ্ঝাটে উপভোগ করতে পারছেন, তাঁকে টিকিট কাটার হ্যাপা পোহাতে হচ্ছে না। দর্শকদের এই অভ্যাসকে আমূল পাল্টে দেওয়া খুবই কঠিন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নেটফ্লিক্স এরই মধ্যে বৈশ্বিক বিনোদন জগতে ‘দৈত্য’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি চায়, তাদের সিনেমা যেন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি না পেলেও পুরস্কার পায়! আর এই জায়গাতেই গোল বাধছে। নেটফ্লিক্স ডিজিটাল মাধ্যমের ছবিকে হলিউডের বড় বাজেটের ছবির সমকক্ষ বলে বোঝাতে চাইছে। আর হলিউডের স্পিলবার্গের মতো পরিচালক ও বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতেই এর বিরোধিতা করছেন পুরোদমে। দুই পক্ষই শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখছে, এখানে বিনোদন শিল্পের উন্নতির বিষয়টি গৌণ। এবার এই ক্ষমতার লড়াইয়ের মঞ্চে স্রেফ উপলক্ষ হয়েছে অস্কার।
অর্থাৎ, বলাই যায়, বিশ্বের বিনোদন জগতে নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে নেটফ্লিক্স। কে না জানে, একচেটিয়া আধিপত্য কখনোই ভালো কিছু বয়ে আনে না। ওদিকে বিনা যুদ্ধে এক বিন্দু ছাড়ও দিতে চাইছে না হলিউডের প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্রশিল্প। দীর্ঘমেয়াদি এই লড়াইয়ে কে জিতবে—এর উত্তর জানতে অপেক্ষা ছাড়া উপায়ন্তর নেই।
তথ্যসূত্র: ফোর্বস, বিবিসি, লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস, এনবিসি নিউজ, সিএনএন ও হলিউড রিপোর্টার