কুদ্দুস বয়াতির নতুন স্বপ্ন
কুদ্দুস বয়াতির কথা মনে আছে আপনাদের? ওই যে, ‘এই দিন দিন না, আরও দিন আছে’ গেয়ে যিনি এই দিনটাকে সেই দিনের কাছে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই কুদ্দুস বয়াতি এসেছেন তাঁর নতুন স্বপ্নের গল্প শোনাতে। আমরা গল্পটা শুনতে বসি তাঁর মুখোমুখি।
কুদ্দুস বয়াতি শুরু করেন একেবারে শুরু থেকে। ‘জানেন, আমি কিন্তু এক টাকার বাউল?’ আমরা নড়েচড়ে বসি। কুদ্দুস বয়াতি সামনে রাখা বিস্কুটে কামড় দিয়ে চায়ে চুমুক দেন। মাথায় ঢিলে হয়ে আসা বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে তৈরি ব্যান্ডেনা খুলে আবার টাইট করে বাঁধেন। তারপর বলেন, ‘আবদুল বারিক নামে আমার এক ফুপা ছিলেন। তিনি আমাকে খুব আদর করতেন। আমি তো ছোটবেলা থেকে মনের আনন্দে গান করি। তো ফুপা ও বেশ কজন মুরব্বিকে একদিন গান শোনালাম। গান শুনে খুশি হয়ে ফুপা আমাকে এক টাকা দিয়েছিলেন। ওই সময় ধান ছিল ৩-৪ টাকা মণ।’
ওটাই ছিল কুদ্দুস বয়াতির প্রথম আয়। তারপর দেশ-বিদেশে অনেক গান করেছেন। টেলিভিশন ও রেডিও মাতিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্রে গান করেছেন।
‘১৯৯২ সালে গেয়েছিলাম “এই দিন দিন না আরও দিন আছে”। হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতো ঘুরে বেড়িয়েছি ওই সময়। আজকে শিক্ষার যে জোয়ার, আপনাদের কি মনে হয় না এটার পেছনে একটু হলেও আমার অবদান আছে? হুমায়ূন আহমেদের লেখা সেই গানটার মাধ্যমে সারা দেশে শিক্ষার জোয়ার বয়ে গিয়েছিল ওই সময়।’
বিদেশের অভিজ্ঞতা মনে করে বলেন, ‘অনেক মানুষ দেখেছি, বিদেশে গিয়ে ঠিকঠাক আচরণ করেন। কিন্তু দেশে এসেই দেখা যায় পানি খেয়ে বোতলটা রাস্তায় ফেলে দিচ্ছেন। অথচ এটা তাঁর রাস্তায় ফেলার কথা না। আমরা কি দেশের চেয়ে বিদেশকে বেশি ভালোবাসি? সবাই যার যার জায়গা থেকে সচেতন হলে দেশটা কত সুন্দরভাবে গড়ে তোলা যায়।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই গান ধরেন। ‘শোনো শোনো দেশবাসী শোনো কই তোমারে, পরিবেশ ঠিক রাখো সবারই অন্তরে।’
এবার শুরু করেন তাঁর স্বপ্ন নিয়ে। ‘আমি সবার মাঝে বেঁচে থাকতে চাই। এ কারণে আমি একটা ফাউন্ডেশন করেছি। নাম দিয়েছি কুদ্দুস বয়াতি ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশন নিয়ে ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ঘুরেছি। সবার সঙ্গে কথা বলেছি। অনেকেই বলতেন, “ফাউন্ডেশন করে টাকাওয়ালারা। আপনার কি আছে?” আমি উত্তরে বলেছি, আমার কাছে এক টাকা আছে। আর আছে স্বপ্ন ও মানুষের ভালোবাসা।’
স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে একটু থামেন বয়াতি। কিছু একটা ভাবেন। তারপর গড়গড় করে বলেন, ‘যারা আমার ডাকে সাড়া দিয়ে স্কুলে গেছে, তাদের মধ্যেই তো আমার স্বপ্নের বীজ বোনা আছে। তাদের হাত ধরে দেশও এগিয়ে যাচ্ছে এবং ডিজিটাল হচ্ছে। তাই আমার ফাউন্ডেশনের অধীনে একটা লোকজ জাদুঘর ও লোকজ ইনস্টিটিউট করতে চাই।’
জানতে চাই এটা কোথায় করবেন?
কুদ্দুস বয়াতি ব্যান্ডেনা থেকে বের হয়ে আসা চুল ঝাঁকি দিয়ে বলেন, ‘করব না, অলরেডি কিছু কাজ এগিয়ে নিয়েছি। আমার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার রাজীবপুর গ্রামে। পৌরসভার কাছে। সেখানে ৭০ শতক জমির মধ্যে কাজ শুরু করেছি। এরই মধ্যে চারতলার ভিত দিয়ে একতলা শেষ করেছি। প্রায় দুই হাজার স্কয়ার ফুট জায়গা নিচতলায়। সেখানে তাড়াতাড়ি কার্যক্রম শুরু করব।’
ফাউন্ডেশনের গল্প চলতে থাকে। কুদ্দুস বয়াতি বলেন, ‘আমার অন্য কোনো পেশা নাই। অর্থের কোনো উৎস নাই। শুধু গানই আমার একমাত্র আয়ের উৎস। এই টাকা দিয়ে সংসার চালিয়েছি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছি। তারপর একটু একটু করে সঞ্চয় করে গড়ে তুলেছি এই ফাউন্ডেশন। কিন্তু এখন আর পারছি না। টানাটানিতে পড়ে গেছি।’
সেই টানাটানিটা আদতে অর্থের। জানান, অনেক লোকসংগীতশিল্পী অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটান। অনেকের পরিবারে অর্থকষ্ট। ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করাতে পারেন না। এই ফাউন্ডেশন কাজ করবে তাঁদের জন্য।
ফাউন্ডেশন থেকে শুধু তাঁদের সহযোগিতা করবেন, আর কোনো পরিকল্পনা নেই?
বলেন, ‘শুধু সহযোগিতা না। আমার ইচ্ছা তাঁদের যন্ত্রপাতি কিনে দেওয়া, নিয়মিত গানের চর্চা, লোকগানের উৎসব, সর্বোপরি লোকগানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাজ করবে এই ফাউন্ডেশন।’
জানালেন, এরই মধ্যে সমাজসেবা থেকে নিবন্ধন করা হয়েছে এই ফাউন্ডেশনের। কাজ তো চলছেই। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন। তাই বয়াতি চান, সমাজের বিত্তবানেরা এগিয়ে আসবেন। পাশে থাকবেন। কারণ, তিনি িবশ্বাস করেন গানই তাঁকে ‘কুদ্দুচ্ছ্যা’ থেকে কুদ্দুস বয়াতি বানিয়েছে। তাই এই গানই পূরণ করবে তাঁর স্বপ্ন।