এখন গালি দিলে ভিউ বাড়ে, গালি দিলে তিনি নামকরা নায়ক!
তখন ২২ বছরের তরুণ। এর মধ্যেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে অভিনয়শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। কিন্তু অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছিলেন না। দীর্ঘ সময় চেষ্টা চালিয়ে যান। বিটিভিতে নিয়মিত যাওয়া–আসার কারণে নজরুল ইসলাম নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানের সহকারী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই প্রথম টেলিভিশনে মুখ দেখানোর সুযোগ হয় অভিনেতা মীর সাব্বিরের। জীবনের প্রথম অভিনয়ে সংলাপ দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তবুও সেটিই ছিল অভিনয়জীবনের স্মরণীয় দিন।
মীর সাব্বিরের ক্যারিয়ার শুরু হয় ‘ইত্যাদি’ দিয়ে। তখন ‘ইত্যাদি’ প্রচারিত হলে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। সেই আয়োজনে অংশ নিতে পারাটাই ছিল এই অভিনেতার জন্য অনেক বড় ঘটনা। সেখানে সংলাপ নেই, সেটা নিয়ে ভাবেননি এই অভিনেতা।
মীর সাব্বির বলেন, ‘প্রথম যেদিন অভিনয় করি, তখন পাশে ছিলেন অভিনেতা জিল্লুর রহমান ভাই, সাইফুদ্দিন ভাই। তাঁদের পাশে অভিনয় নিয়ে অনেক নার্ভাস আমি। আমার কাছে এখনো মনে হয়, সংলাপ না থাকায় সেদিন আমার জন্য সুবিধা হয়েছিল। কারণ, সংলাপ থাকলে মনে হয় বলতে পারতাম না।’
‘ইত্যাদি’তে অভিনয় করে নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেতে দুই বছরের বেশি সময় লেগেছে। তখন এটাই ছিল স্বাভাবিক নিয়ম। কাউকে কাউকে আরও দীর্ঘদিন টেলিভিশনে অভিনয়ের সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। সাব্বির বলেন, এখন তো ইউটিউব ট্রেন্ডিং বা চার কি পাঁচ মিলিয়ন ভিউ হলেই তিনি নিজেকে তারকা মনে করছেন। আর ৫ থেকে ১০ মিলিয়ন ভিউ হলে সেই অভিনেতা পাগল হয়ে যান। তাঁর নামের আগে লেখা হয় জনপ্রিয় তারকা। তাঁকে আর পায় কে? কিছুটা আফসোসের সুরেই বললেন মীর সাব্বির।
একটা সময় বিটিভিতে প্রচারিত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান একসঙ্গে দেখেছেন কোটি দর্শক। সেগুলোর কোনো পরিমাপক ছিল না। সেই কাজগুলোর মধ্য দিয়ে তারকাদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পেত। তখন কোনো কিছুই সহজ ছিল না। এখন নষ্ট হয়ে গেছে সব। ভিউয়ের পেছনে ছুটছেন শিল্পীরা। দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সরে যাচ্ছেন। এখন যত আজেবাজে কাজ, সেগুলোরই ভিউ বাড়ছে। এখন গালি দিলে ভিউ বাড়ে, এখন গালি দিলে তিনি নামকরা নায়ক। আবার এগুলোর সঙ্গে যেসব অভিনয়শিল্পী মানাতে পারছেন না, বলা হচ্ছে সময়ের সঙ্গে তাঁরা মানানসই নন—আক্ষেপ করে বলেন মীর সাব্বির।
সাব্বির আরও বলেন, ‘একজন এ টি এম শামসুজ্জামান শিল্পী হয়ে মারা গেছেন। কারণ, তাঁরা শিল্পের ক্ষতি করেননি। শেষ দিন পর্যন্ত মান ধরে রেখেছিলেন। শিল্পের সঙ্গে আপস করেননি। তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পেত। সেখানে এখন শিল্পকে শেষ করা হচ্ছে। একসময় যাঁদের নাটক একসঙ্গে কোটি মানুষ দেখেছেন, তাঁদের বলা হচ্ছে গালি দিতে। গালি দিলে নাটক হিট হয়। আর না দিলে তিনি সময়ের সঙ্গে নেই বলা হয়। এখন সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছি। এগুলো নিয়ে যাঁরা কথা বলার, তাঁরাও চুপ। এখন আর টেকসই অভিনয়শিল্পী তৈরি হচ্ছে না। ভিউ দিয়ে শিল্পীদের মৃত্যু ঘটিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
বর্তমান নাটকের মান ও শিল্পীদের অভিনয় নিয়ে সিনিয়রদের কথা বলা উচিত বলে মনে করেন মীর সাব্বির। তিনি মনে করেন, টেকসই অভিনয়শিল্পী তৈরি না হলে অভিনয় ও নাটকের মান আরও কমবে। এর মধ্যে দিয়ে দর্শকের চাহিদা কমবে। সাব্বির বলেন, অভিনয়শিল্পীরা যেভাবে দেশে তৈরি হচ্ছিল, সেখানে এখন বড় বাধা ভিউ। কারণ, শিল্পীকে তাঁর অভিনয় নয়, ভিউ দিয়ে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই সেই অভিনেতা চাইবেন, যেভাবে ভিউ বেশি পাওয়া যায়, সেই পথে হাঁটতে। কারণ, সে সহজে তারাকা হতে চায়। কিন্তু এটা কি সহজ কোনো পথ? এটা চর্চার বিষয়।’
এ সময় তিনি প্রথমবার ‘ইত্যাদি’তে কাজের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘প্রথম যখন আমাকে টেলিভিশনে দেখা যাবে, তার আগেই আমার আত্মীয়স্বজন সবাইকে বলে দিয়েছি। তাঁরা সবাই পরিবার নিয়ে আমার অভিনয় দেখেছেন। খুশি হয়েছেন। কিন্তু এখন বলা হয়, পরিবার নিয়ে কেউ নাটক দেখেন না। তাই বলে কি ইউটিউবে নাটকের নামে যা ইচ্ছা বানিয়ে ছাড়িয়ে দেওয়া যাবে? আমাদের একজন আবুল হায়াত আছেন, এমন অনেক গুণী শিল্পী আছেন। তাঁদের কতটা মূল্যায়ন করা হচ্ছে। অথচ তাঁরাই আমাদের পথপ্রদর্শক।’