শুটিংয়ের গ্রাম
>গাজীপুর জেলার পুবাইল থেকে দেড় কিলোমিটার উত্তরের একটি গ্রাম ভাদুন। গ্রামটি এখন পরিচিত শুটিংয়ের গ্রাম নামে। ঢাকা থেকে ভাদুনের দূরত্ব মাত্র ২১ কিলোমিটার। গ্রামটিতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মাত্র একটি শুটিং বাড়ি ছিল। সময়ের প্রয়োজনে ছোট–বড় মিলিয়ে সেই সংখ্যা ১৪–তে দাঁড়িয়েছে। ভাদুন কীভাবে শুটিংয়ের গ্রাম হয়ে ওঠে, সেটাই জানাচ্ছেন মনজুরুল আলম।
ভাদুন গ্রামে শুটিংয়ের শুরু
ভাদুন গ্রামে শুটিং শুরু হয় ১৯৯৭ সাল থেকে। সে সময় নাটক সিনেমায় গ্রামের প্রয়োজন হলেই নির্মাতাদের ছুটতে হতো মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে। একই লোকেশনে, একই ফ্রেমে বারবার শুটিং করে ক্লান্ত হয়ে ওঠেন প্রয়াত নির্মাতা আমজাদ হোসেন। সহকারী পরিচালক ও প্রযোজককে সঙ্গে নিয়ে গোলাপী এখন ট্রেনে ছবির এই নির্মাতা বেরিয়ে পড়েন নতুন গ্রামের খোঁজে। অনেক খোঁজার পর একটা গ্রাম মনে ধরে তাঁর। গ্রামের প্রবেশপথেই রেললাইন, কিছুদূর এগোতেই নদী, বিল, সেতু, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। এই গ্রামেই পছন্দসই খোলামেলা ছিমছাম একটি বাড়ি পেয়ে যান নির্মাতা আমজাদ হোসেন। কিন্তু বাদ সাধেন গৃহকর্তা। তিনি নাটক–সিনেমার শুটিংয়ের জন্য বাড়ি ব্যবহার করতে দেবেন না। বাড়ির মালিককে রাজি করাতে পরিচালক আমজাদ হোসেন নিজেই বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বললেন। প্রথম আলোর সঙ্গে সেই দিনের স্মৃতিচারণা করছিলেন লোকেশন খোঁজার দলে থাকা সহকারী পরিচালক এস এ হক অলিক। এখন তিনি নির্মাতা আর ডিরেক্টরস গিল্ডের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। সেই বাড়ির মালিক সেলিম সরদারের সঙ্গেও কথা বলি আমরা। তিনি বলেন, ‘সে তো ২০-২৫ (২৩ বছর হবে) বছর আগের কথা। গোলাপী এখন ট্রেনে ছবি দেখে আমজাদ হোসেনের ভক্ত হই। এমন গুণী মানুষটার সামনে কি আর না করা যায়।’ জনপ্রিয় সব তারকা নিয়ে আমজাদ হোসেন ভাদুন গ্রামে শুরু করেন আগুন লাগা সন্ধ্যা ধারাবাহিকের শুটিং। আমজাদ হোসেনের ছেলে নির্মাতা সোহেল আরমান সে সময়ের কথা মনে করে বলেন, ‘২৬ পর্বের সেই নাটকটি একুশে টিভিতে প্রচারিত হয়েছিল।’
তারকা ও নির্মাতাদের শুটিং বাড়ি
তারকা ও নির্মাতারা দীর্ঘদিন ধরে ভাদুনের ভাড়া বাড়িতে শুটিং করতে করতে এখন নিজেরাই বনে গেছেন শুটিং হাউসের মালিক। পুবাইল কলেজ গেট থেকে হাতের ডানে ৫ মিনিট হাঁটলেই পাওয়া যায় চলচ্চিত্র অভিনেতা শাকিব খানের শুটিং বাড়ি, নাম ‘জান্নাত হাউজ’। তবে লোকমুখে ‘শাকিবের হাউজ’ নামেই পরিচিত এটা। আরেকটি বাড়ির নাম পরিচিত হয়ে উঠছে ‘মোশাররফ করিম-শামীম জামান-আ খ ম হাসানের বাড়ি’। শামীম জামান জানালেন, তাঁরা তিন বন্ধু মিলে বাড়িটি তিন বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছেন। এই বাড়িতেই মোশাররফ করিম প্রযোজিত দুটি নাটকের শুটিং হয়। নিজেদের শুটিং না থাকলে অন্য নির্মাতাদের এটি ভাড়া দেন তাঁরা। মোশাররফ করিম বলেন, ‘বাড়িটা তিন বছরের জন্য লিজ নেওয়ার কারণ হলো নিজস্ব পরিবেশে শুটিং করা। এখানকার বেশির ভাগ শুটিং বাড়ির পরিবেশ ভালো না।’ একই এলাকায় আরেকটি বাড়ির নাম সালাহউদ্দিন লাভলুর বাড়ি। সালাহউদ্দিন লাভলু জানালেন, দুই–আড়াই বছর হলো, তিনি বাড়িটি ছেড়ে দিয়েছেন।
বাণিজ্যিকভাবে ভাদুনে শুটিং
একে একে নির্মাতারা ভাদুনে যেতে শুরু করলে এখানে তৈরি হতে থাকে বাণিজ্যিক শুটিং হাউস। ২০০২ সাল পর্যন্ত এখানে বিনা পয়সায় শুটিং করতেন নির্মাতারা। গ্রামের মানুষেরা শখ করে শুটিং করতে দিতেন তাঁদের। ২০০৩ সালে প্রথম ‘শাহিনের বাড়ি শুটিং হাউজ’ দিয়েই ভাদুনে শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে শুটিং হাউসের যাত্রা। প্রথম দিকে ভাড়া ছিল দিনপ্রতি এক–দেড় হাজার টাকা। শাহিন শুটিং হাউসের মালিক শাহিনুর রহমান বললেন, ‘আমিও প্রথম টাকা ছাড়াই সম্পর্কের খাতিরে শুটিং করতে দিতাম। কখনো শুটিং না করতে দিলে পরিচালকেরা অনুরোধ করতেন, টাকা দিতে চাইতেন। তখনই ভাবনায় আসে বাণিজ্যিকভাবে শুটিং হাউস করার।’
সালাহউদ্দিন লাভলু পরিচালিত হাড়কিপ্টা, সাকিন সারিসুরি, গরুচোর, পত্রমিতালী, কলেজ স্টুডেন্ট, ঢোলের বাদ্যি, ঘর কুটুম, আলতা সুন্দরী, ওয়ারেন নাটকগুলো প্রচারিত হবার পর ব্যাপকভাবে গ্রামের নাটক দর্শকপ্রিয়তা পায় । নির্মাতারা ভাদুনে যেতে শুরু করেন। ভাদুনে বাড়তে থাকে শুটিং বাড়ি।
সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘২০০৭ সালে ছিল মাত্র একটি শুটিং বাড়ি। এখন ভাদুনেই সক্রিয় আছে ৯টি শুটিং বাড়ি, আরও দুটি বাড়ি তৈরি হচ্ছে। গ্রামের পাশেই রয়েছে আরও তিনটি শুটিং বাড়ি। একের পর এক শুটিং বাড়ি গড়ে উঠলেও এখানে নেই মালিকদের কোনো সংগঠন, নেই শুটিংয়ের তেমন ধরাবাঁধা নিয়মনীতির বালাই।
তারকাদের পছন্দ ধীরেন বাবুর মিষ্টি
পুবাইলে শুটিং করেছেন আর ধীরেন বাবুর মিষ্টি খাননি এমন অভিনেতা, অভিনেত্রী, নির্মাতা, ক্যামেরাম্যান খুব বেশি খুঁজে পাওয়া গেল না। অভিনেত্রী নাদিয়া জানালেন, ‘আমি তো সময় পেলে ধীরেন বাবুর দোকানে বসেই সকালের নাশতা করি, এরপর শুটিংয়ে যাই। মিষ্টি দইটা বেশি খাই। আসার সময় কিনেও আনি।’ অভিনেতা জাহিদ হাসান বললেন, ‘ধীরেনের মিষ্টি পছন্দ করি। আগে মাঝেমধ্যে আসার সময় কিনে নিয়ে আসতাম।’ দোকানটি বর্তমান চালাচ্ছেন দীপক সরকার নান্টু । তিনি জানান, ‘চঞ্চল চৌধুরী, মোশাররফ করিম, সাদেক বাচ্চু, বৃন্দাবন দাস, শাহনাজ খুশি, সালাহউদ্দিন লাভলু, মীর সাব্বির, ফজলুর রহমান বাবু, হুমায়রা হিমু—শুটিংয়ে আসা সবাই আমার মিষ্টি খুব পছন্দ করেন। মিষ্টি বিক্রির মাধ্যমেই অনেক তারকাদের সঙ্গে এখন আমার ভালো খাতির।’
ভাদুনে শুটিংয়ের সুবিধা–অসুবিধা
প্রায় ১৫ বছর আগে ভাদুনে প্রথম অভিনয় করতে আসেন অভিনেতা আবুল হায়াত। তিনি বলেন, ‘ভাদুনে একসময় যাতায়াত সুবিধা ছিল, ঢাকা থেকে মাত্র ২১ কিলোমিটার। গ্রামের পরিবেশ মনোরম ছিল। এখন বলতে গেলে আগের মতো কোনো সুবিধাই নাই!’ অভিনেতা মোশাররফ করিম ভাদুনে প্রথম তরিক আলী হাডারী নাটকের শুটিং করেন। তিনি বলেন, ‘ভাদুনের শুটিংয়ের শিডিউল হলেই মনে হয় অবকাশ যাপনে যাচ্ছি। কিছুদিন আরাম–আয়াশে কাটবে। ভাদুনের খোলা হাওয়ায় প্রাণ ভরে কিছুটা নিশ্বাস নেওয়া যাবে। কিন্তু সেই সুন্দর গ্রামটিকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ফ্রেমগুলো দিন দিন ছোট হয়ে আসছে।’ অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘প্রচুর যানজট, বেশির ভাগ শুটিং হাউসের পরিবেশ আগের মতো নেই, গ্রামের সেই প্রাণখোলা ব্যাপারটাও নাই। তা ছাড়া ভাদুনের এমন কোনো জায়গা বাকি নেই, যেখানে আমি শুটিং করি নাই।’ নির্মাতা সালাহউদ্দিন লাভলু । তিনি বলেন, ‘দর্শকদের একই লোকেশন দেখানো আর কত? পুবাইলের এমন একটা জায়গা নেই, যেটা আমার ফ্রেমে ধরা বাকি।’ দর্শকদের নতুন গ্রাম দেখানোর জন্য তিনি এখন থেকে কুষ্টিয়া শুটিং করছেন।
তারকার রাঁধুনি
কোন তারকা কোন ধরনের খাবার পছন্দ করেন, এটা জানেন বাবুর্চি আবদুর রাজ্জাক সরকার। তিনি ভাদুনের শুটিং হাউসগুলোয় খাবার সরবরাহ করেন। শুধু তিনিই নন, ভাদুনের শুটিং হাউসগুলোতে খাবার সরবরাহ করেন সুলতান মিয়া ও ফরিদ হোসেনও। ফোনে ঠিকানা জেনে সরাসরি তাঁর রান্নাঘরে চলে গেলাম আমরা। তাঁর চুলায় তখন পেঁপে দিয়ে মুরগির মাংস রান্না হচ্ছে। ‘কে খাবে এটা?’ রাজ্জাক জানালেন, ‘এটা মোশাররফ করিমের খুবই পছন্দের খাবার।’ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোন তারকার কী খাবার পছন্দ, জানেন আপনি?’ রাজ্জাক মিয়া একটু চিন্তা করে বললেন, ‘১৪ বছর ধরে শুটিংয়ে খাবার দিতে দিতে এখন সবার পছন্দই জানি। জাহিদ হাসানের পছন্দ গরুর মাংস, মাষকলাই ডাল আর ছোট মাছ। চঞ্চল চৌধুরীর পছন্দ দেশি মুরগি, মাছ, বিভিন্ন সবজি। সালাহউদ্দিন লাভলু শাকসবজি, ভর্তা–ভাজি বেশি পছন্দ করেন।’
ভাড়ায় মেলে সব
বাণিজ্যিকভাবে শুটিং শুরুর পর থেকে ভাদুনের মানুষ সবকিছু টাকার বিনিময়ে ভাড়া দিতে শুরু করেন। স্থানীয় আমির হোসেন জানান, ‘ভাদুনে টাকা দিলেই ভাড়া পাওয়া যায় গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, নানা বয়সী মানুষ, দোকান, গাছ, খেত খামার, নৌকা।’ তিনি জানালেন একটি ক্ষোভের কথাও। তিনি কদিন আগে ১৫০ টাকায় একটি ছাগল ভাড়া দিয়েছিলেন। ছাগলটি রাতে ফেরত না দিয়েই চলে যায় শুটিং দল। পরের দিন তিনি ছাগলটিকে শিয়াল কামড়ানো অবস্থায় খুঁজে পান। এমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাঝেমধ্যে কষ্টের কারণ হয় ভাদুনবাসীর।
শুটিংয়ের গ্রামের ভিডিও দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে