লিমাকে পাওয়া গেল, তবে...

>
এখন ও তখনকার লিমা
এখন ও তখনকার লিমা
নব্বই দশকের জনপ্রিয় নায়িকা লিমা। অভিনয় করেছেন সালমান শাহ, আলমগীর, ওমর সানীর মতো অভিনেতাদের বিপরীতে। মাত্র ৮ বছরের অভিনয়জীবনে ২৫টি সিনেমায় অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পান। ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে হঠাৎ অভিনয় থেকে দূরে চলে যান। এরপর ২১ বছর ধরে লিমার কোনো খোঁজ নেই। এত বছর পর অভিনয় থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং পরবর্তী সময়ের গল্প শোনালেন লিমা।

লিমার খোঁজে
লিমা এখন কোথায় থাকেন? এই তথ্য খুঁজতে গিয়ে শুরুতেই হতাশ হতে হলো। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির কাছে তাঁর কোনো তথ্য নেই। লিমা যেসব শিল্পী ও নির্মাতার সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের অনেকের কাছে খোঁজ করেও সঠিক তথ্য জানা গেল না। কেউ বলেছেন, লিমা সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় থাকেন। বাণিজ্যিক ধারার জনপ্রিয় সিনেমার নির্মাতা দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ছবিতেই বেশি অভিনয় করেছেন লিমা। এই নির্মাতা বলেন, ‘ভালো একটা ক্যারিয়ার ছেড়ে হঠাৎ চলে গেল লিমা। এখন আর তাঁর খবর কেউই জানি না।’ অবশেষে মাসখানেক ধরে খোঁজ খবর নেওয়ার পর পাওয়া গেল লিমার ঠিকানা। 

লিমা থাকেন মোহাম্মদপুরে
একটি পাঁচতলা বাড়ির দোতলার কলবেল চেপে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর সাত–আট বছর বয়সী এক মেয়ে দরজা খুলে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই বাসায় অভিনেত্রী লিমা থাকেন?’ শুনে মেয়েটি নিরুত্তর তাকিয়ে থাকে। বললাম, ‘আগে সিনেমায় অভিনয় করতেন, নাম লিমা।’ মেয়েটি বলল, ‘এসব আমি জানি না।’ ভেতর থেকে একজনের ডাকে মেয়েটি চলে গেল। ঠিক মিনিট দুয়েক পর একজন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি বের হলেন। আবার বললাম, ‘অভিনেত্রী লিমা কি এই বাসায় থাকেন?’ ভদ্রলোক আমার পরিচয় জেনে একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘সে তো অনেক আগে অভিনয় করত। এখন আর অভিনয় করে না, তাকে নিয়ে আর না লেখাই ভালো।’ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম এই ভেবে যে লিমা এ বাসায় থাকেন। যাঁর সঙ্গে কথা হলো, তিনি লিমার বাবা মোহম্মদ মোহর আলী। তিনি বললেন, ‘আর যদি কিছু জানতেই চান, তাহলে আমার নম্বর নিয়ে যান। ফোন দিয়েন। বাসায় আজ একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠান। আজ কথা বলা সম্ভব নয়।’

দুই সপ্তাহ ধরে ফোনে চেষ্টার পর আবার লিমার বাবার সঙ্গে দেখা করলাম। দোতলা বাড়ির নিচে কথা বলছি। প্রথমেই মোহর আলী বললেন, ‘চলচ্চিত্র জগৎ ছেড়ে দিয়েছে, এখন এগুলো নিয়ে লিখে আর কী হবে? তারপরও যদি জানতে চান, চলুন, বাসায় গিয়ে কথা বলি।’

লিমার প্রথম অভিনয়
বাংলাদেশের নব্বই দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী লিমা। পারিবারিক নাম শামীমা আলি লিমা। জন্ম ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯, কুমিল্লার দাউদকান্দি, বর্তমানে তিতাস থানায়। বেড়ে ওঠা ঢাকায়। তিন বোনের মধ্যে লিমা সবার বড়। লিমার অভিনয় শুরু শৈশব থেকেই। বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের পর ঢাকায় ব্যবসা শুরু করেন। মোহর আলী ছিলেন শিল্পমনস্ক। মোহাম্মদপুরে থাকতেই ‘কুট্টি ভাই’ নামে একজনের সঙ্গে মোহর আলীর পরিচয় হয়। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রকৌশলী ছিলেন। তিনিই লিমাকে দেখে বিটিভির অঙ্কুর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বলেন। অঙ্কুরের মধ্যমেই লিমার অভিনয়ের শুরু। তখন লিমার বয়স ৯ বছর। লিমা ক্রমেই অভিনয়, নাচ, গানে ভালো করতে থাকেন। এরপর যুক্ত হন সিনেমায়।

সিনেমাযাত্রা
লিমা প্রথম নায়িকা চরিত্রে সিনেমায় অভিনয় করেন মাত্র ১৪ বছর বয়সে। কমল সরকার পরিচালিত ছবিটির নাম সুখের আগুন। ব্যবসায়িকভাবে সেভাবে সফল না হলেও প্রথম ছবিতেই লিমার অভিনয় নির্মাতা দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর দৃষ্টিগোচর হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৩ সাল থেকে লিমা সবচেয়ে বেশি দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ছবিতে অভিনয় করেন। এরপর টানা ৮ বছরে ২৫টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন লিমা। বেশির ভাগ ছবি ছিল ব্যবসাসফল। লিমা বলেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি, এতটা খ্যাতি সিনেমা থেকে আমি পাব।’ অভিনয়ে তাঁর ব্যস্ততা দিন দিন বাড়তে থাকে। 

লিমা তখন তুমুল জনপ্রিয়
লিমার ক্যারিয়ার পুরোপুরি বদলে দেয় নব্বই দশকের জনপ্রিয় ছবি প্রেমগীত। ছবিটি ১৯৯৩ সালে মুক্তি পায়। ছবিটির নির্মাতা দেলোয়ার জাহান ঝন্টু। প্রেমগীত ছবি দিয়ে জনপ্রিয় সারির অভিনেত্রীদের তালিকায় চলে আসেন লিমা। এ ছবি দিয়ে জনপ্রিয়তা পান অভিনেতা ওমর সানীও। ছবির ‘আমার সুরের সাথি আয় রে’ গানটি এখনো অনেকেরই মনে আছে। ঢাকাই চলচ্চিত্রজগতে লিমা তখন জনপ্রিয় নায়িকার নাম। সমানতালে অভিনয় করেছেন সে সময়ের জনপ্রিয় তারকা সালমান শাহ, ওমর সানী, জসীম, বাপ্পারাজ, অমিত হাসান, রুবেলের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে। মাসের বেশির ভাগ সময় শুটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকা এই নায়িকা যেন হঠাৎই সবার অগোচরে অভিনয় থেকে ছুটি নিলেন।

লিমার অভিনয়কে হঠাৎ বিদায়
একসঙ্গে অনেক ছবির কাজ তড়িঘড়ি করে শেষ করেন লিমা। এরপর নীরবেই সিনেমাকে বিদায় জানান। সে জন্য শেষ ছবি কোনটা, নাম মনে করতে পারলেন না। অভিনয় থেকে সরে যাওয়া প্রসঙ্গে লিমা বলেন, ‘আমার পরিবার একদমই সাদামাটা। বাবা প্রথম দিকে চাইতেন অভিনয় করি, তাই শখের বশে অভিনয়ে আসি। অভিনয় করতে করতে একসময় মোটা হয়ে যাচ্ছিলাম। স্থূলতা দিন দিন বাড়ছিল। অন্যদিকে বাবাও পারিপার্শ্বিক চাপে চাইছিলেন না আর অভিনয় করি। তখন নিজের সিদ্ধান্তেই অভিনয় থেকে সরে আসি।’

লিমার অভিমান
কোনো অভিমান কি ছিল? জবাবে পাই লিমার একটি দীর্ঘশ্বাস। হয়তো স্মৃতিতে অনেক কিছুই মনে কড়া নাড়ছে। লিমা হঠাৎ হেসে বলেন, ‘অনেকে মনে করে, কোনো অভিমান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। কিন্ত আমার কারও ওপর কোনো অভিমান নেই। সিমপ্লি ব্যক্তিগত কারণ।’ অভিনয় ছাড়ার পর লিমা মোহাম্মদপুরে বিউটি পারলারের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর টানা ২১ বছর লিমা সিনেমার কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি।

লিমার ব্যক্তিগত...
লিমার এখন বেশির ভাগ সময় কাটে বাসায়, বাবা, বোন ও বোনের সন্তানদের সঙ্গে। মেজ বোনের তিন মেয়েকে নিয়েই তাঁর যত ব্যস্ততা। মিডিয়ার কোনো খবরই রাখেন না। শুধু এটুকু বললেন, ‘শুনেছি এখন নায়িকা হওয়া সহজ, কিন্তু আমাদের সময় এত গুণী অভিনেত্রী ছিলেন, যাঁদের ভিড়ে অভিনয়ে নিজের জায়গা তৈরি খুব কঠিন ছিল।’ আর কী কী খবর জানেন লিমা, এ বিষয়ে হেসে বলেন, ‘আমি এখন এক সাধারণ মানুষ। বর্তমান নায়ক, নির্মাতা—কারও নামই জানি না।’ 

লিমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা
মোহম্মদ মোহর আলী ১৯৭১ সালে ২ মার্চ প্রথমে দেড় সপ্তাহের ট্রেনিং এবং পরে ভারত থেকে এক মাসের ট্রেনিং নিয়ে কুমিল্লার রণাঙ্গনের যুদ্ধে অংশ নেন। লিমার বাবা জানান, প্রথম দিকে মেয়ের অভিনয় নিয়ে অনেকেই নানা কথা বলত। আমাদের গ্রামের মাওলানা আবদুল বাকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাকে একদিন বলেছিলেন, ‘যে যেখানে ভালো করে, সেটাই তার জন্য ভালো। নইলে সেই জায়গাগুলো চলবে কীভাবে। যদি কেউ ভালো থাকতে চায়, সেটা সব জায়গাতেই ভালো থাকা সম্ভব। এরপর লিমাকে অভিনয়ে উৎসাহ দিই। কিন্তু পরে অনেকেই ভিন্ন রকম কথা বলত। তা ছাড়া মেয়ে মোটা হয়ে যাচ্ছিল, তার তো একটা জীবন আছে, সব ভেবে অভিনয় থেকে দূরে সরিয়ে নিই।’