অর্কেস্ট্রার পূর্ণতায় আমার সোনার বাংলা

গুলশানের একটি বাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রার সদস্যরা বাজাচ্ছেন l ছবি: সাহাদাত পারভেজ
গুলশানের একটি বাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রার সদস্যরা বাজাচ্ছেন l ছবি: সাহাদাত পারভেজ

অর্কেস্ট্রা ভাবলেই যেমন চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রশস্ত মঞ্চে সার সার বসে ও দাঁড়িয়ে থাকা শিল্পীদের হাতে চেলো, বেহালা, বাঁশি, ক্ল্যারিওনেট, পারকাশানে ফুটে ওঠা বাদ্য আর সুরের ঐকতান, তেমনই এক দৃশ্য চোখে পড়ল গতকাল সন্ধ্যায়। রাজধানীর গুলশানের একটি বাড়ির হলরুমটিতেও ঠিক তেমনি এক পুরোদস্তুর পেশাদার অর্কেস্ট্রা দলই বাজাচ্ছিলেন।
সংখ্যায় তিরিশ থেকে বত্রিশজন, বিভিন্ন বয়সী ইউরোপীয়। তাঁদের হাতের বেহালার ছড় সুরের অনুরণনে যেন উঠে যাচ্ছিল ছাদের মাথা ফুঁড়ে আকাশের দিকে। কিন্তু তাঁরা মোজার্ট কিংবা বেটোফেন নয়, বাজাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। আমাদের জাতীয় সংগীত। অর্কেস্ট্রা দলের সামনে যিনি নির্দেশকের (কন্ডাক্টরের) ভূমিকায় ছিলেন, শুধু তিনিই পরিচিত। সংগীতকার সানি জুবায়ের।
এই সংগীত-সুরের ঐকতানের মাঝেই কথা বললেন ব্লুজ কমিউনিকেশনসের পরিচালক ফরহাদুল ইসলাম। বাজাচ্ছেন হাঙ্গেরির বিখ্যাত বুদাপেস্ট ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রার শিল্পীরা। তাঁরা অর্কেস্ট্রায় সুর তুলছেন আমাদের জাতীয় সংগীতের; আর তাঁদের দিয়ে আমাদের জাতীয় সংগীত বাজানোর এ উদ্যোগটা ব্লুজ কমিউনিকেশনসের। পরবর্তী সময়ে ব্লুজের এই উদ্যোগের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে ক্রাউন সিমেন্ট। প্রতিষ্ঠানটির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যে আয়োজন, সেখানে অন্যান্য গানের পাশাপাশি পুরোদস্তুর অর্কেস্ট্রায় বাজানো হবে আমাদের জাতীয় সংগীত। ফরহাদুল ইসলাম জানালেন, একসময় সংগীতকার সমর দাস যুক্তরাজ্য থেকে জাতীয় সংগীতের যে অর্কেস্ট্রা তৈরি করিয়ে এনেছিলেন, সেটি ছিল শুধু ব্রাসব্যান্ডের। পূর্ণাঙ্গ অর্কেস্ট্রার নোটেশন নয়। বিশ্ব অঙ্গনে, বড় আয়োজনে বাজানোর মতো পূর্ণ কোনো অর্কেস্ট্রা স্বরলিপি আমাদের হাতে ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কম্পোজিশন অনুসরণ করে সম্প্রতি জাতীয় সংগীতের জন্য অর্কেস্ট্রার স্টাফ নোটেশন করেছেন আমাদের দেশের কম্পোজার সানি জুবায়ের। সানি জুবায়ের সুইডেনে পাশ্চাত্যের উচ্চাঙ্গ সংগীতের ওপর পড়াশোনা করেছেন।
এরই মাঝে এগিয়ে এলেন অর্কেস্ট্রার ম্যানেজার ও প্রধান জেভিয়ার ডুবুক। কেমন লাগছে বাংলাদেশে এসে? এমন প্রশ্নে বর্ষীয়ান মানুষটি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন—তিনি অভিভূত। বাংলাদেশে এসে ভালো লাগছে, সবার আন্তরিকতায় মুগ্ধ। আর সবচেয়ে আপ্লুত হয়েছেন এ দেশের জাতীয় সংগীতের প্রথম পূর্ণ নোটেশন অর্কেস্ট্রায় বাজাবেন এই অনন্য সুযোগটির কারণে। কথা প্রসঙ্গে বললেন, তাঁদের অর্কেস্ট্রার দলটি ৭০ জনের। এখানে এসেছেন ৩৪ জন। চেলো, ডাবল বেজ, ক্ল্যারিওনেটের পাশাপাশি সিমবালনও আছে। তাঁর কথা ছাপিয়ে আবারও সুর জেগে উঠল, বাঁশির সুরের সঙ্গে ঐক্য গড়ল চেলো আর বেহালা। জাতীয় সংগীতের সময় দাঁড়িয়ে সম্মান জানাচ্ছিলেন উপস্থিত সবাই। জেভিয়ার ডুবুকও সটান দাঁড়িয়ে। সানি জুবায়েরের আঙুলের নির্দেশনায় তখন ফুটে উঠছিল অর্কেস্ট্রার সুর। জাতীয় সংগীতের এই পূর্ণ অর্কেস্ট্রার নোটেশনটি এখন থেকে সংরক্ষিত থাকবে। বিশ্ব অঙ্গনে আমাদের আর বিব্রত হতে হবে না। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে, যেকোনো রাষ্ট্রীয় কিংবা আন্তর্জাতিক আয়োজনে পূর্ণতায় অর্কেস্ট্রার ঐকতানে বাতাসে ভাসবে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’
কাল ৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেমে অনুষ্ঠিত হবে ক্রাউন সিমেন্টের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বিশেষ অনুষ্ঠান। সেখানেই হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রা দলটি বাজাবে আমাদের জাতীয় সংগীত।