কাজের লম্বা ফিরিস্তি শুনে বোঝা যায়, বেশ ব্যস্ততায় সময় কাটে তাঁর। যাঁর কথা বলছি, সেই হুর-এ-জাহান অবশ্য বিনয়ের সঙ্গে হেসে বললেন, ‘অনেক না ঠিক, একটু ব্যস্ত থাকি আর কি।’ কী নিয়ে ব্যস্ততা? বিস্তারিত শুনতে বেশ সময় লেগে গেল। পড়াশোনার পাশাপাশি বিতর্ক, নাচ, আবৃত্তি, উপস্থাপনা, অভিনয় তো আছেই। ক্যাম্পাসেও কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয় হুর-এ-জাহানকে। একে একে সেগুলো বললেন স্নাতক পড়ুয়া এই শিক্ষার্থী।
ফেনীর ছাগলনাইয়া একাডেমি থেকে এসএসসি পাস করেছেন। এরপর ঢাকায় এসে ভর্তি হয়েছেন কুইন্স কলেজে। উচ্চমাধ্যমিক পেরোনোর পর তাঁর ঠিকানা হয়েছে ঢাকার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ)। সাংবাদিকতায় পড়ার ইচ্ছে ছিল হুর-এ-জাহানের। মা-বাবার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে ভর্তি হন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগে। কিন্তু এই বিভাগে কিছুতেই মন টিকছিল না। অবশেষে বিভাগ পরিবর্তন করে থিতু হয়েছেন কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলে।
স্কুলে পড়ার সময় নিয়মিত বিতর্ক আর আবৃত্তি করতেন। নাচে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তবে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে বড়রা নাচের মুদ্রা শিখিয়ে দিত। দেখে দেখে একটু একটু করে শিখেছেন হুর। ঢাকায় আসার পর রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে এক মাস সালসা শিখেছিলেন। এরপর বাফায় ক্ল্যাসিক্যাল। কিন্তু নিয়মিত চর্চা করা হচ্ছে না। কারণ ব্যস্ততা যে অন্য দিকে আরও আছে। ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক সংগঠনের ‘হেড অব পারফরম্যান্স অ্যান্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট অরগানাইজেশনাল সেক্রেটারি’ তিনি। পদবিটা যেমন লম্বা, কাজও কম নয়!
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে নাচ, আবৃত্তি, উপস্থাপনা তো করেনই, ক্লাবের ছোট ভাইবোনদের প্রশিক্ষণও দেন হুর-এ-জাহান। শেখান র্যাম্পের হাঁটাচলা। মঞ্চের সাজসজ্জা তদারকির ভার থাকে তাঁর ওপর। চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন ক্লাব থেকে। মাঝে মাঝে কর্মশালার আয়োজন করেন। আর ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ প্রতিযোগিতায় কাজ করেন বিচারক হিসেবে। আন্তবিশ্ববিদ্যালয় কোনো প্রতিযোগিতা হলে দলবল নিয়ে অংশগ্রহণ করেন হুর।
এসব তো গেল ক্যাম্পাসজীবনের কথা। হুর-এ-জাহান শুধু ক্যাম্পাসের তারকাই নন, টেলিভিশনেও তিনি সরব। স্নাতক শুরু করার পর থেকে টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন। তবে শুরুটা হয়েছিল রেডিও থেকে। সিটি এফএম-এর আরজে ছিলেন। বেসরকারি টিভি চ্যানেল বাংলাভিশনে চার বছর ধরে ‘দিন প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করছেন। এই চ্যানেলেই ‘সকাল বেলার রোদ্দুর’ ও ‘মিউজিক ক্লাব’ অনুষ্ঠান দুটির উপস্থাপক হিসেবে নিয়মিত দেখা যায় হুর-এ-জাহানকে। এবারের ঈদে উপস্থাপনা করেছেন ‘লাক্স স্টাইল ফাইল’। আলাদা করে বললেন বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট সিরিজের সময় প্রচারিত ‘ক্রিকেট হাইলাইটস’ ও ‘ক্রিকেট এক্সট্রা’ অনুষ্ঠান দুটোর কথা। খুব আনন্দ নিয়ে উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। মাস সাতেক হলো উপস্থাপনা করছেন এনটিভির অনুষ্ঠান ‘এই সময়ের গান’।
শখের বশে গত ঈদে একটি নাটকেও অভিনয় করেছেন হুর। পাঁচ পর্বের ধারাবাহিকটির নাম ছিল হিরো কেন ভিলেন। প্রচারিত হয়েছে দীপ্ত টিভিতে। এখন কাজ করছেন বাংলাভিশনের একটি ধারাবাহিক নাটকে। নাম খেলোয়াড়। করপোরেট অনুষ্ঠানগুলোতে উপস্থাপনা করেন প্রায়ই। যত যা কিছুই করুন না কেন, উপস্থাপনা ছাড়তে চান না হুর। তিনি বলেন, ‘উপস্থাপনা আমি শখের বশে করিনি। এটা আমার পেশাও না। এটা আমার ভালোবাসা।’ বোঝা গেল, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলের এই ছাত্রীকে ‘প্রোগ্রামিং’-এর চেয়ে টিভি বা মঞ্চের ‘প্রোগ্রাম’গুলোই বেশি টানে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি নিজে নিজেই শিখেছেন অভিনয়, আবৃত্তি, উপস্থাপনা। এখনো প্রতিনিয়তই শিখছেন।
স্কুলে পড়ার সময় নানা ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। একবার বিতর্কে সেরা হলেন, একবার নাচে জেলায় দ্বিতীয় হলেন। কিন্তু পুরস্কার তাঁকে টানে না কখনো। মনের আনন্দে এসবে অংশ নিয়ে শুধু উপভোগ করেন।
বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হয়ে এত কিছু কী করে সামলান? পড়ার পাশাপাশি তাঁর শখের কাজগুলো চালিয়ে যাওয়া যে কঠিন, হুর-এ-জাহান সেটা মেনে নিলেন। ‘কাজটা সত্যিই কঠিন। বন্ধুরা সাহায্য করে। ক্লাস মিস করলে ওদের কাছ থেকে জেনে নিই, কী কী পড়ানো হলো।’ বলছিলেন তিনি। কখনো সকালে অনুষ্ঠান শেষে তাঁকে বিকেলের ক্লাসে ছুটতে হয়। কখনোবা সকালে ক্লাস করে তারপর যান শুটিংয়ে। শুটিংয়ের দলটাও খুব সাহায্য করে তাঁকে। পড়াশোনায় যেন ব্যাঘাত না হয়, সে জন্য তাঁর ওপর কাজ চাপিয়ে দেওয়া হয় না। আর পরিবার তো সব সময় পাশে আছেই। ক্যাম্পাসের গণ্ডি পেরিয়ে একদিন সারা দেশের পরিচিত মুখ হতে চান হুর-এ-জাহান।