শহরতলির বালুচর এলাকা থেকে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়মুখী পেছনের ফটক দিয়ে হাঁটতে গেলেই আওয়াজটা কানে আসে—সমস্বরে, সুর করে পড়ার আওয়াজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তো এমন উচ্চ স্বরে, শব্দ করে পড়ার কথা নয়। তাহলে? তবে কি কোনো নাটকের মহড়া? ধীরে ধীরে আওয়াজটা বাড়ে। কাছাকাছি যেতেই প্রশ্নের উত্তর মেলে। শখানেক ছোট ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনের বারান্দার মেঝেতে চট পেতে বসেছে, একসঙ্গে পড়ছে।
কী হচ্ছে এখানে? কৌতূহল মেটাতে এগিয়ে আসেন এক যুবক। তিনি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। জানালেন, ‘স্বপ্নরথে আলোর পথে’ স্লোগান নিয়ে ‘পাঠশালা ২১’ নামে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের একটা সংগঠন রয়েছে। এ সংগঠনের মাধ্যমে তাঁরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি স্কুল পরিচালনা করছেন। বাসায় গৃহশিক্ষক রেখে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর মতো সক্ষমতা যাদের নেই, মূলত তাদেরই বিনে পয়সায় পাঠদান করা হয় এখানে। প্রতি শুক্র ও শনিবার এ স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম চলে। একজন গৃহশিক্ষক ক্লাসের বাইরে যেভাবে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করান, সেটাই এই স্কুলে করা হয়।
আরেকটু এগোতেই কথা হলো সংগঠনের আরও কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে। তাঁরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ২০১২ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শুরু থেকেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনার বিকাশ ঘটাতে তাঁরা কাজ করে আসছেন। বর্তমানে স্কুলটিতে ১৩০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিশু শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নরত ছেলেমেয়েরা এখানে পড়ছে। ছাত্রছাত্রীদের বেশির ভাগেরই বাসা ক্যাম্পাসের আশপাশে। শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদে অধ্যয়নরত ও সংগঠনটির সদস্য ৫০ জন শিক্ষার্থী।
পাঠশালা ২১-এর বর্তমান সভাপতি শামীম রেজা কৃষি অনুষদের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা চাঁদা দিয়ে এই স্কুলের ব্যয়ভার বহন করেন। সপ্তাহে দুদিন পাঠদানের পাশাপাশি ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নাশতা বিতরণ, বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদ্যাপন, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, শীতবস্ত্র ও বছরে দুবার শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়। মূলত দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতেই সংগঠনটি কাজ করছে।
২০১২ সালে যখন স্কুলটির কার্যক্রম শুরু হয়, তখন এখানে পড়তে এসেছিল তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী আবিদা আক্তার। তার বাবা রাজমিস্ত্রি, মা গৃহিণী। দুজনেই অসুস্থ। আবিদারা পাঁচ ভাই, এক বোন। দরিদ্র পরিবারে যখন পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়েছিল, তখনই পাঠশালা ২১-এর সদস্যরা তাকে এই স্কুলে আসতে উৎসাহিত করে। এরপর আবিদা নিয়মিত এখানে এসেছে, পড়েছে। ২০১৮ সালে মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। এখন সে সিলেট পলিটেকনিক্যাল কলেজে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (ডিপ্লোমা) বিভাগে পড়ছে। আবিদা বলে, ‘এ স্কুলের কাছে আমার
অনেক ঋণ। আমি এখনো এখানে পড়ি এবং ছোট ক্লাসের ছেলেমেয়েদের পড়াই।’
পাঠশালা ২১-এর সহসভাপতি ইমতিয়াজ চৌধুরী পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের চতুর্থ বর্ষে। তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের পড়াতে ভালো লাগে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আমরা এ কাজ করছি।’ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সালমান সায়েম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক প্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি বলেন, ‘নিজেদের খরচ বাঁচিয়ে অনেকেই আমরা স্কুলটি চালাতে টাকা দিই। আমরা স্বপ্ন দেখি, স্কুলটি একসময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে পরিচালিত হবে। শুধু পাঠদান নয়, কোনো শিক্ষার্থী টানা কয়েক দিন না এলে আমরা তার বাড়িতে খোঁজ নিই। পরিবারে কোনো সমস্যা হলে সমাধানের চেষ্টা করি।’