শিক্ষার মানে নজর কম, লাভে ঝোঁক বেশি
• উপাচার্য নেই এক-পঞ্চমাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে
• জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরা মূলত খণ্ডকালীন
• গবেষণা কম
• আয়-ব্যয়ে নয়ছয়
এ মুহূর্তে দেশে শখানেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। মোটামুটি চলনসই হলেই শিক্ষার্থীরা সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। পড়ার খরচ অনেক। পাঠদানে ঘাটতিও কিন্তু অনেক। আবার নামে ‘অলাভজনক’, তবে অনেকগুলোতেই লাভ তোলার প্রবণতা লক্ষণীয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), একাধিক গবেষণা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধান এমনটাই বলছে।
এখন মাঠে আছে ১০৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, অর্ধেকের বেশিই ঢাকায়। শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ৯৫টিতে। সেগুলোর এক-পঞ্চমাংশে উপাচার্য আর এক-চতুর্থাংশে সহ-উপাচার্য নেই। অধ্যাপকসহ জ্যেষ্ঠ ও পিএইচডিধারী শিক্ষকদের বড় অংশই খণ্ডকালীন। একাডেমিক কাউন্সিলের সভাও ঠিকমতো হয় না।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ফির পার্থক্য বিরাট। গবেষণায় বরাদ্দ অপ্রতুল বা নেই। এগুলোর অর্ধেকের বেশি চলছে কোষাধ্যক্ষ ছাড়া। সরকারকে বার্ষিক হিসাব নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেয় অল্প কটি মাত্র। উদ্যোক্তাদের ট্রাস্টি পর্ষদ সম্মানীসহ নানা খাতে আর্থিক সুবিধা নেয়।
ইউজিসির চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ভালো উদ্দেশ্যে ও প্রয়োজনের তাগিদে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছিল। কিন্তু এসব ত্রুটিবিচ্যুতির কারণে শিক্ষার মান খারাপ হচ্ছে। হাতে গোনা কয়েকটি বাদে আইনত অলাভজনক এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানাভাবে লাভ নেয়।
উদ্যাক্তাদের সংগঠন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলছেন, উপাচার্য নিয়োগ, নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়মিত জমা দেওয়াসহ এ ধরনের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে তাঁরা প্রতিনিয়ত সদস্যদের তাগিদ দিচ্ছেন।
মাথার তিন পদ ফাঁকা
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ থাকা অতিজরুরি। নিয়মানুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে আচার্য ও রাষ্ট্রপতি এই তিন পদে নিয়োগ দেবেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সর্বশেষ তথ্য বলছে, চালু ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০টিতে উপাচার্য নেই। সহ-উপাচার্য নেই ৭২টিতে। আর কোষাধ্যক্ষ নেই ৫৩টিতে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বেআইনিভাবে নিজেরা ‘ভারপ্রাপ্ত’ উপাচার্য নিযুক্ত করেছে।
তবে রাষ্ট্রপতি-নিয়োজিত উপাচার্য না থাকলে শিক্ষার্থীরা স্থায়ী শিক্ষা সনদ পান না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এক চিঠিতে ইউজিসিকে বলেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জরুরি ভিত্তিতে এই তিন পদ পূরণের উদ্যোগ নিতে।
বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পদগুলো লম্বা সময় ধরে খালি আছে। যেমন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। সেখানে তিন পদই খালি। অবশ্য ‘ভারপ্রাপ্ত’ উপাচার্য আবদুল্লাহ হাসান সাদেক বলেছেন, তাঁরা পদগুলোতে নিয়োগের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষরা প্রায়ই অভিযোগ করে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির প্রক্রিয়াগত সমস্যার কারণে উপাচার্য নিয়োগে দেরি হয়। ওই দুটি দপ্তরের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলছেন, এ কথা কিছুটা ঠিক। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই অনেক সময় ত্রুটিপূর্ণ প্রস্তাব পাঠায়। কখনো পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার লক্ষ্যে তালিকায় ভুলভাল নাম ঢোকানো থাকে। তখন কাজ আটকে যায়, আদালতেও গড়ায়।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ১০৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই তিন পদের ৪১৬ জন উপযুক্ত ব্যক্তি লাগবে। আছে ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এতজন উপযুক্ত মানুষ পাওয়াও কঠিন।
খণ্ডকালীন শিক্ষকই ভরসা
ইউজিসির হিসাবে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মোট শিক্ষক আছেন ১৬ হাজারের মতো। এঁদের প্রায় ৩২ শতাংশ শিক্ষক খণ্ডকালীন, বিশেষত অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের পদে। প্রায় আড়াই হাজার অধ্যাপকের দুই-তৃতীয়াংশই খণ্ডকালীন। আর প্রায় দেড় হাজার সহযোগী অধ্যাপকের অর্ধেকের বেশি হচ্ছেন খণ্ডকালীন।
একইভাবে পিএইচডিধারী প্রায় সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষকের দুই-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি খণ্ডকালীন। খণ্ডকালীন শিক্ষকেরা মূলত বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন।
২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, কোনো বিষয়ে পূর্ণকালীন শিক্ষকের সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি খণ্ডকালীন শিক্ষক রাখা যাবে না। সার্বিক হিসাবে খণ্ডকালীন শিক্ষকের অনুপাত সীমার মধ্যে আছে। তবে জ্যেষ্ঠ ও পিএইচডিধারী শিক্ষকদের মধ্যে এই অনুপাতটি উদ্বেগজনক। তা ছাড়া নির্দিষ্ট কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা বিষয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা থাকতে পারে।
পিএইচডিধারী শিক্ষক নিয়ে এগিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি।
সমন্বিত কোনো বেতনকাঠামো বা চাকরিবিধি নেই। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতন একেক রকম। যেমন রাজশাহীর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রভাষকদের মাসিক বেতন ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। একই শহরে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষকেরা পান মাসে ২৫ থেকে ২৮ হাজার টাকা। এখানে সহকারী অধ্যাপকেরা আবার এর দ্বিগুণ বেতন পান।
ইউজিসির গত বছর প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি পর্ষদ স্বজন-কবলিত হওয়ায় মেধাবী শিক্ষকেরা এসব জায়গায় পেশা গড়তে দ্বিধা করেন। সুযোগ পেলেই তাঁরা অন্যত্র চলে যান। নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও এমনটা হচ্ছে।
এদিকে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা লেগে আছে। চাকরিচ্যুত করার পরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মীদের ভবিষ্য তহবিল ও গ্রাচুইটি পরিশোধ করা হয় না।
মোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৪টি
শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ৯৫টিতে
মোট শিক্ষক ১৬,০২০
শিক্ষার্থী ৩,৫৪,৩৩৩
পূর্ণকালীন ১০,৯৩২ খণ্ডকালীন ৫,০৮৮
মোট অধ্যাপক ২,৪০৩ খণ্ডকালীন ১,৬১১
সহযোগী অধ্যাপক ১,৪৪০ খণ্ডকালীন ৭৬০
পিএইচডিধারী ৩,৪১৬ খণ্ডকালীন ২,০১০
উপাচার্য নেই ২০টিতে
কোষাধ্যক্ষ নেই ৫৩টিতে
সূত্র: শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও প্রথম আলোর অনুসন্ধান
ফি ও গবেষণা
আইনানুযায়ী, প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর সঙ্গে দেশের আর্থসামাজিক মানদণ্ড বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের ফি ঠিক করবে। এটা ইউজিসিকে জানাতে হবে। প্রয়োজনে ইউজিসি ফি কমাতেও বলতে পারে। কিন্তু ফির সমন্বিত কোনো মাত্রা ধরে দেওয়া নেই। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক রকম ফি।
এই প্রতিবেদক ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন। কোনো কোনোটির ছেলেমেয়েরা ফি গ্রহণযোগ্য বলেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, অনেক বেশি ।
রাজশাহীর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র তারিন আল রাহাবাত বলেন, তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেয়ে এখানে পড়ছেন। বিবিএর পুরো কোর্সের ফি ৩ লাখ টাকার কিছু বেশি। রাহাবাত অবশ্য বেশ কিছুটা ছাড় পেয়েছেন।
নাটোরের রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটিতে একই কোর্সের ফি প্রায় ২ লাখ টাকা। আবার ঢাকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এই ফি ৭ লাখ পর্যন্ত যেতে পারে।
ইউজিসির তথ্য বলছে, ২২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৭ সালে গবেষণা খাতে ১ টাকাও বরাদ্দ রাখেনি। অন্য কয়েকটি গবেষণা খাতে নামকাওয়াস্তে বরাদ্দ রেখেছে। শূন্য বরাদ্দ রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আছে রাজশাহীর নর্থ বেঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয়। এর রেজিস্ট্রার রিয়াজ মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের আয় কম। গবেষণা খাতে বাজেট রাখা যায়নি।
তবে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্র্যাক, নর্থ সাউথ, আইইউবি, এআইইউবি, ইস্ট ওয়েস্ট, ইউল্যাব, ড্যাফোডিল ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
আয়-ব্যয়ে নয়ছয়
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইউজিসিকে আয়-ব্যয়ের হিসাব দিয়েছে। দেখা যায়, ২০১৭ সালে এগুলোর মোট আয় ছিল ৩ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। সে বছরের প্রদর্শিত ব্যয়ের অঙ্কও প্রায় সমান। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই কিন্তু আইন মেনে ও নিয়মিত নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেয় না।
অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় তো কখনোই নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেয়নি। এগুলো হলো ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, জার্মান ইউনিভার্সিটি, টাইমস ইউনিভার্সিটি ও গণবিশ্ববিদ্যালয়।
সরকারকে বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেওয়াটা আইনত বাধ্যতামূলক। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সংশ্লিষ্ট শাখা বলছে, মাত্র ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয় হালনাগাদ নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কয়েকটির ভালো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নাম আছে।
ইউজিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নানাভাবে টাকা নয়ছয় করার অভিযোগ আনলেন। কখনো চেয়ারম্যানসহ ট্রাস্টি পর্ষদের সদস্যরা সভায় অংশগ্রহণের জন্য মোটা সম্মানী নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে বিদেশ ভ্রমণ করেন, সাধারণ তহবিলের টাকা ইচ্ছামতো তোলেন এবং গাড়ি ও জনবল ব্যবহার করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়িয়ে থাকেন। তিনি বলছেন, নিজেদের পরিবারের সদস্যদের ট্রাস্টি বানিয়ে মালিকেরা এগুলো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে চান।
ইউজিসি ২০১৫ সালে তদন্ত করে বলে, ঢাকার নামকরা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিরা সম্মানী ভাতা বাবদ লক্ষাধিক টাকা করে নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলেছিল, ভাতার অঙ্কটি ৫০ হাজার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ২০১৪ সালের একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বোর্ড সদস্যরা সচরাচর ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে সম্মানী নিচ্ছেন।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদার কারণেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এখন শিক্ষার মানোন্নয়ন চাইলে নিয়মকানুন মানানোর ব্যবস্থা করতে হবে।