শিক্ষা আইন কি আলোর মুখ দেখবে

ফাইল ছবি

এক দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষা আইনের খসড়া নিয়ে কেবল আলোচনাই হচ্ছে। এই চূড়ান্ত হচ্ছে, তো আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। একটি আইন প্রণয়ন করতে এত দীর্ঘ সময় লাগার উদাহরণ দেশে আর আছে কি না, তা সংশ্লিষ্ট কেউ বলতে পারেন না। মূলত নোট-গাইড বা সহায়ক বই এবং কোচিং-প্রাইভেটের মতো কিছু বিষয় রাখা না-রাখা নিয়েই আইনের খসড়াটি এত দীর্ঘ বছর ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে।

অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নিরীক্ষা ও আইন) খালেদা আক্তার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষ করে তাঁরা শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়ন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছেন। সেখানে এ নিয়ে সভাও হয়েছে। এখন তাদের (মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ) সিদ্ধান্ত পেলে বোঝা যাবে, তাদের পর্যবেক্ষণ কী।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো আশা করছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পূরণ করে খসড়াটি তাড়াতাড়ি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা যাবে। যদিও এর আগে একাধিকবার শিক্ষা আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তা কখনো ফেরত দেওয়া হয়েছে বা কখনো ফেরত আনার মতো ঘটনা ঘটেছে।

এখন একটু দেখা যাক, এই আইনটি কেন ও কীভাবে আলোচনায় এল এবং কী আছে আইনের খসড়ায়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন করে চলবে, সেটি ঠিক করা হয়েছিল ২০১০ সালে প্রণয়ন করা জাতীয় শিক্ষানীতিতে। দেশের নামকরা শিক্ষাবিদদের দিয়ে প্রণীত ওই শিক্ষানীতি মোটামুটি সর্বজনের স্বীকৃতি পেয়েছিল। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু আইন বা প্রজ্ঞাপন দিয়ে অনেকটা অ্যাডহক ভিত্তিতে চলা দেশের শিক্ষা কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ কিছু কারণে ওই শিক্ষানীতিতে সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছিল।

আইনের বিষয়ে ওই শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, শিক্ষাসংক্রান্ত সব আইন, বিধিবিধান, আদেশগুলো একত্রিত করে শিক্ষানীতির আলোকে এবং এর যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

এমন প্রেক্ষাপটে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের পরপর ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে ২৪টি উপকমিটি গঠন করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যার একটি ছিল শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়নের জন্য। এরপর দীর্ঘ সময়ে আইনের একাধিক খসড়া করা হলেও আইনটি এখন পর্যন্ত করতে পারেনি সরকার। এর আগে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আইনের একটি খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু তাতে ‘ছায়া শিক্ষার’ নামে কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনের বৈধতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া তাতে সহায়ক বা অনুশীলন বই প্রকাশেরও সুযোগ রাখা হয়েছিল। এ নিয়ে তখন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলে খসড়াটি পর্যালোচনার জন্য ফেরত আনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে খসড়াটি চূড়ান্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেখানে আবার কোচিং, প্রাইভেট ও সব ধরনের নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বই নিষিদ্ধের বিধান রাখা হয়েছিল।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদ শুরু হলে শিক্ষা আইনের খসড়াটি আবারও পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং সাবেক একজন সচিবকে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারের বর্তমান মেয়াদও প্রায় পৌনে তিন বছর হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো আইনটি চূড়ান্ত করা গেল না।

উপরন্তু যা জানা যাচ্ছে, তাতে সহায়ক বই, কোচিং, প্রাইভেটসহ যে বিষয়গুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে, সেই বিষয়গুলো নানা কায়দায় রেখেই আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত হচ্ছে। প্রস্তাবিত আইনে নোট–গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত নিষিদ্ধ রাখা হচ্ছে। কেউ এই বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। ১৯৮০ সালে করা একটি আইনেও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নোট-গাইড নিষিদ্ধই আছে। ফলে এখন নোট-গাইডের পরিবর্তে অনুশীলন বই বা সহায়ক পাঠ্যবই চলছে, যার কাজ নোট-গাইডের মতোই।

প্রস্তাবিত আইনে নোট-গাইড বন্ধ করা হলেও সরকারের অনুমোদন নিয়ে সহায়ক পুস্তক, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে। তবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সহায়ক পুস্তক ক্রয় বা পাঠে বাধ্য করতে পারবেন না। এসব বই কিনতে বা পাঠে বাধ্য বা উৎসাহ দিলে, তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে।

কিন্তু সরকারের অনুমোদন ছাড়া পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু এবং তার আলোকে পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নাবলির উত্তর পত্রিকায় মুদ্রণ বা ইলেকট্রিক মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না বলেও খসড়ায় রয়েছে।

নিবন্ধন নিয়ে কোচিং চালানোরও সুযোগ রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। কোচিং সেন্টারের বিষয়ে আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদানের জন্য কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা বা কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করা নিষিদ্ধ গণ্য হবে না। তবে কোচিং সেন্টারে কোনো শিক্ষক তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাতে পারবেন না। এ ছাড়াও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না।

অবশ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে সম্মতির ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণি কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর বা আগে নিয়ম মেনে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করার সুযোগ এখনো রয়েছে। বর্তমানেও এই নিয়ম আছে, কিন্তু এ নিয়ে আগ্রহ কম।

শিক্ষা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চান, নোট-গাইড নিষিদ্ধের পাশাপাশি কোচিং-বাণিজ্যও বন্ধ হোক। আমরাও চাই, প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনটি আর বানরের তৈলাক্ত বাঁশে ওঠানামার মতো না করে চূড়ান্ত হোক, যে আইন পুরোনো সংকটকে জিইয়ে না রেখে প্রকৃতপক্ষেই দেশের শিক্ষাকে সঠিক পথে চালিত করতে সহায়তা করবে।