জাবিতে প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ
শতকোটি টাকা অপচয়ের শঙ্কা
আগের ভবনটি সম্প্রসারণের সুযোগ থাকার পরও ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন ভবন নির্মাণের চেষ্টা চলছে। এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা।
একটি অনুষদের শিক্ষকদের অফিসকক্ষই নেই। অন্য বিভাগের ধার করা কক্ষে বসেন তাঁরা। শ্রেণিকক্ষের অভাবে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে হয় মিলনায়তনে। নেই ল্যাবরেটরি ও শৌচাগার। দেশের পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বলা হলেও আবাসিক হলের সংকট প্রকট। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা থাকেন গণরুমে। এই চিত্র ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের।
দুটি প্রশাসনিক ভবন থাকার পরও শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে আরেকটি প্রশাসনিক ভবন। এমন অপচয়ের প্রতিবাদ জানিয়ে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন এমনকি বিক্ষোভ মিছিল পর্যন্ত করেছেন শিক্ষার্থীরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দোতলা ও একটি পাঁচতলা প্রশাসনিক ভবন আছে। দোতলা ভবনটি পুরোনো ও পাঁচতলা ভবনটি নতুন প্রশাসনিক ভবন নামে পরিচিত। নকশা অনুযায়ী নতুন প্রশাসনিক ভবনের মাত্র অর্ধেক নির্মাণ করা হয়েছে। এই ভবন আরও অন্তত দ্বিগুণ সম্প্রসারণ করা সম্ভব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল কার্যালয় সূত্র বলছে, নতুন প্রশাসনিক ভবনটির নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৭ কোটি টাকা। অথচ আগের পাঁচতলা প্রশাসনিক ভবনটি সম্প্রসারণ করলে ব্যয় হবে ৪০ কোটি টাকা। তাই আরেকটি প্রশাসনিক ভবন নির্মাণে প্রায় ১০০ কোটি টাকা অপচয় হবে বলে মনে করছেন পরিকল্পনাবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনেরা।
আর্থিক অপচয় তো বটে, ভবন নির্মাণের ফলে ভূমির অপচয়, ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যহানির ঘটনাও ঘটবে। এ অন্যায্য পরিকল্পনা থেকে সরে আসা উচিত।অধ্যাপক আদিল মুহম্মদ খান, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাবি
প্রকৌশল কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এ প্রকল্পের প্রথম ধাপে ১০ তলাবিশিষ্ট ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। দ্বিতীয় ধাপে নতুন এ প্রশাসনিক ভবনসহ ১৪টি স্থাপনার নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়েছে ৮ জুন।
বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর্থিক অপচয় তো বটে, ভবন নির্মাণের ফলে ভূমির অপচয়, ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যহানির ঘটনাও ঘটবে। এ অন্যায্য পরিকল্পনা থেকে সরে আসা উচিত।’
ডিপিপিতে ভবন নিয়ে লুকোচুরি
একনেক অনুমোদিত প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার এ উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাবে (ডিপিপি) বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু পুরোনো প্রশাসনিক ভবন আছে বলে দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, দোতলা একটি প্রশাসনিক ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু ডিপিপিতে নতুন পাঁচতলা প্রশাসনিক ভবনটির কথা উল্লেখ নেই। এটিকে স্পষ্ট তথ্যগত প্রতারণা বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মঞ্চের সমন্বয়ক রায়হান রাইন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তথ্য গোপন করে জনগণের টাকায় অপ্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণের বিষয়টি সম্পূর্ণ অপচয়ের শামিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এটা মেনে নেওয়া যায় না।’
এ বিষয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এ প্রকল্পের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির মতামতের ভিত্তিতে এ প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত পাস হয়।’
পাঁচতলা ভবনটি সম্প্রসারণ সম্ভব
নতুন প্রশাসনিক ভবন নামে পরিচিত পাঁচতলা ভবনটির অর্ধেক নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৬ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল কার্যালয় সূত্র জানায়, নকশায় এ ভবনকে দক্ষিণ ব্লক বলা হয়েছে। এই প্রশাসনিক ভবনের উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব পাশে আরও তিনটি ব্লক তৈরির নকশা আছে। সম্প্রসারণের সুবিধার্থে ভবনের পাশে রডও বের করে রাখা হয়েছে।
ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি রাকিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ ১০ বছর ধরে কোনো অবকাঠামো পায়নি। এ অনুষদের শিক্ষকেরা ধার করা জায়গায় ভাগাভাগি করে বসেন। শিক্ষার্থীরা ক্লাস করেন জহির রায়হান মিলনায়তনের কক্ষে। সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো আধুনিক ল্যাবরেটরি তো নেই–ই; এ বিভাগে কোনো শৌচাগারও নেই। তাই প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের বিলাসিতায় না গিয়ে একাডেমিক ভবন নির্মাণের বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নূরুল আলম বলেন, ‘এ প্রকল্পের কোনো অংশেই আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তাই এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’
শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ বাড়ছে
নতুন আরেকটি প্রশাসনিক ভবন না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন নির্মাণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার রেখে আলাদাভাবে নতুন করে গ্রন্থাগার নির্মাণের পরিকল্পনাসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ।
এসব দাবিতে ১৪ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সম্মেলনকক্ষে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন হয়। একই দাবিতে ১৬ জুন বিক্ষোভ মিছিল করেন তাঁরা।