প্রাথমিকে শিক্ষার্থী কমেছে সাড়ে ১৪ লাখ

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের করা ২০২১ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারির তথ্য। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমেছে ৩ শতাংশ।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা

দেশে করোনাকালে যেসব খাতের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে, তার মধ্যে একটি হলো শিক্ষা। করোনা সংক্রমণ শুরুর দুই বছর পর এখন সেই চিত্র উঠে আসছে। সরকারের নতুন তথ্য বলছে, করোনাকালে এক বছরের ব্যবধানে প্রাথমিকে মোট শিক্ষার্থী কমেছে সাড়ে ১৪ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রাক্‌-প্রাথমিক স্তরে আট লাখের বেশি শিশুশিক্ষার্থী কমেছে। অথচ প্রতিবছর শিক্ষার্থী বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। সারা দেশে প্রাথমিক স্তরে বিদ্যালয়ের সংখ্যাও কমেছে। বিদ্যালয় কমেছে মূলত বেসরকারি খাতের।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের করা ২০২১ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারিতে (এপিএসসি) এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত মার্চে এই শুমারি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিকে এক বছরে মোট শিক্ষার্থী কমার পাশাপাশি ঝরে পড়ার হারের ব্যবধান কিছুটা কমেছে। অর্থাৎ প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির পর প্রাথমিক শিক্ষা (পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত) শেষ করা শিক্ষার্থীর হার বেড়েছে।

পরীক্ষা না হওয়া ঝরে পড়ার হার কমার একটি কারণ হতে পারে। কিন্তু এখানে পদ্ধতিগত কারণে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার তথ্য ঝরে পড়ার হিসাবে আসেনি।
মনজুর আহমেদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক

অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে যেতে পারে। কিন্তু শুমারিতে দেখা গেছে, এবার ঝরে পড়ার হার এক লাফে ৩ শতাংশ কমেছে। ঝরে পড়ার হার এখন ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ, যা ২০২০ সালে ছিল ১৭ দশমিক ২০ শতাংশ।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ঝরে পড়ার হিসাবটি করা হয় একজন শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির পর পঞ্চম শ্রেণি শেষ করা পর্যন্ত কোনো পর্যায়ে পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়ল কি না।

করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে গত দুই বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। অ্যাসাইনমেন্টের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে সব শিক্ষার্থীকে ওপরের শ্রেণিতে ওঠানোর সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে ঝরে পড়ার হার কমেছে। একই সঙ্গে দুই বছর ধরে বিদ্যালয়গুলোতে ছুটি থাকায় অনেক শিশু বিশেষ করে প্রাক্‌-প্রাথমিক স্তরের অনেক শিশু ভর্তিই হয়নি। এর ফলে মোট শিক্ষার্থী কমতে পারে।

বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঁচ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদি প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষা চালু আছে; যেটি ‘শিশু শ্রেণি’ নামে পরিচিত। এক বছর প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ছয় বছরের বেশি বয়সী শিশুদের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়।

এর আগে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২১ সালের তথ্য নিয়ে করা প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছিল, ২০২১ সালে মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী আগের বছরের তুলনায় ৬২ হাজার ১০৪ জন কমেছে। বর্তমানে দেশে মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২০ হাজার ২৯৪টি।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থী ছিল ২ কোটি ১ লাখের বেশি। যা ২০১৮ সালে ছিল ২ কোটি ৯ লাখ ১৬ হাজার।

করোনাকালে প্রাথমিক শিক্ষা

করোনা সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছিল সরকার। দীর্ঘ ১৮ মাস পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নতুন করে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত জানুয়ারিতে আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করে সরকার, যা ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিল। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গত ২২ ফেব্রুয়ারি খুলে দিলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খোলে ২ মার্চ। কিন্তু প্রাক্‌-প্রাথমিক স্তরের শিশুদের সশরীর ক্লাস শুরু হয় আরও পরে গত ১৫ মার্চ থেকে। তা–ও সপ্তাহে দুদিন। ১২ মে থেকে প্রাক্‌-প্রাথমিকের শিশুদেরও প্রতিদিন ক্লাস শুরু হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ এই বন্ধের ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ওপর মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।

বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারির তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে সরকারি ও বেসরকারি (কিন্ডারগার্টেনসহ) মিলিয়ে দেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় কমেছে ১৪ হাজার ১১১টি। ২০২১ সালে বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯১টি, যা আগের বছর ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ২টি। মূলত কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই কমেছে।

শুমারির তথ্য বলছে, ২০২১ সালে সারা দেশে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থী ছিল ২ কোটি ৯০ হাজার ৫৭, যা আগের বছর ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৯১ জন। এর মধ্যে শ্রেণিভেদে প্রাক্‌-প্রাথমিক স্তরেই শিক্ষার্থী বেশি কমেছে।

কয়েক বছর ধরে প্রাথমিকে মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীদের হার বেশি ছিল। তবে শুমারির তথ্য বলছে, এখন ছাত্রীদের হার আগের চেয়ে কিছু কমে ছাত্রদের প্রায় সমান হয়েছে। এবার ছাত্রীদের হার ৫০ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং ছাত্রদের হার ৪৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অথচ ২০২০ সালেও ছাত্রীদের হার ছিল ৫১ শতাংশ এবং ছাত্রদের হার ছিল ৪৯ শতাংশ।

শুমারিতে উঠে আসা প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা না হওয়া ঝরে পড়ার হার কমার একটি কারণ হতে পারে। কিন্তু এখানে পদ্ধতিগত কারণে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার তথ্য ঝরে পড়ার হিসাবে আসেনি।

এই শিক্ষাবিদের ধারণা, ২০২২ সালের তথ্য এলে দেখা যাবে প্রাথমিকে মোট শিক্ষার্থী আরও কমতে পারে। তাঁর পরামর্শ হলো, প্রথমত, যেসব শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের বাইরে রয়ে গেল, তাদের ফিরিয়ে আনতে একটি পরিকল্পনা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, গত দুই বছর ঠিকমতো পড়াশোনা ছাড়াই যারা দুই ক্লাস ওপরে উঠে গেল, তাদের শিখন ঘাটতি পূরণ করতে যথাযথ পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।