কীভাবে বেছে নেব পড়ার বিষয়?
>এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মৌসুম। ছাত্রছাত্রীরা কীভাবে বেছে নেবেন তাঁদের পড়ার বিষয়, এ সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. রাশেদুর রহমান
বছরটা আর দশজনের জন্য যেমনই হোক, একদল স্বপ্নবান তরুণের কাছে ২০১৮ সাল একটু বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে, অনেক প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছেন, এ বছরটাই (২০১৮) তাঁদের বাকি জীবনের জন্য ‘পথনির্দেশক’ হবে। আজ তাঁরা যেমন বীজ বপন করবেন, ভবিষ্যতে তেমনই ফল পাবেন। সারা জীবন যে যোগ্যতা আপনাকে বিশ্বে পরিচয় করাতে জোরালো ভূমিকা রাখবে, সেই বিষয়ে খুবই সাবধানতার সঙ্গে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
নিজেকে আলোকিত করার এই যাত্রায় সঠিক পথ বা পড়ার বিষয় বেছে নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির আবেগ, ইচ্ছে, সামর্থ্য, ধৈর্য ও দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। কতখানি রোমাঞ্চ নিয়ে তিনি সামনের পথটা পাড়ি দিতে চান, সেটাও বিবেচ্য। সবকিছু বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে পড়বেন? ভবিষ্যতে কী নিয়ে কাজ করবেন? কীভাবে নিজের সেরাটা দেবেন? জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কেমন করে নিজের, পরিবার এবং সর্বোপরি দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন?
যেসব তরুণ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছেন, পরামর্শগুলো তাঁদের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সহায়ক হবে বলে আশা করছি। যাঁরা সামনের বছরগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দেবেন, তাঁদেরও এখন থেকেই এই ধাপগুলো মাথায় রাখা উচিত।
বিষয় নির্ধারণের ৯ ধাপ
অনুপ্রেরণার খোঁজে
প্রতিটি বিষয়েরই কোনো না কোনো বিশেষত্ব আছে, আছে নতুন করে জানা এবং তার সঠিক ও সময়োপযোগী বাস্তবায়নের সুযোগ। প্রশ্ন হলো, কোন বিষয়টা আপনাকে আলোড়িত করে, কোনটা আপনার ভেতরে আগ্রহ জাগায়। বিজ্ঞান, প্রকৌশল, ভাষা, শিল্পকলা, সাহিত্য, ব্যবসা—যা-ই হোক না কেন। ভালো লাগার সঙ্গে মিলিয়ে আপনি নিশ্চয়ই কোনো না কোনো বিষয়ের খোঁজ পাবেন। প্রথম কাজই হলো, আপনার অনুপ্রেরণার জায়গাটা খুঁজে বের করা।
আমি কি নিশ্চিত
ধরে নিলাম, আপনি আপনার পছন্দের জায়গাটা খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু অনুপ্রেরণাকে অনুসরণ করার মতো যথেষ্ট আবেগ বা সামর্থ্য কি আপনার আছে? একজন দক্ষ প্রশাসক, উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা, দার্শনিক, কূটনীতিক, শিক্ষক, গবেষক—ভবিষ্যতে যা-ই হতে চান না কেন, স্বপ্নটাকে জয় করতে হলে যে বাড়তি পরিশ্রম করতে হবে, সেটার জন্য কি আপনি তৈরি আছেন? যদি বিষয়টির প্রতি যথেষ্ট আবেগ আপনার থাকে, তাহলে যাত্রাপথে সব বাধা ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করা অনেক সহজ হবে।
বয়স যখন ৪০
৪০ বছর বয়সে আপনি নিজেকে কোথায় দেখতে চান? এখনই সেটা ভাবুন। নির্দিষ্ট একটা পেশার একটা নির্দিষ্ট অবস্থানই ভাবতে হবে, তা নয়। কিন্তু দূরদর্শী হওয়া খুব জরুরি। এগোতে হলে আপনাকে তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। অতএব এখন থেকেই দৃষ্টি থাকতে হবে দূরে।
উচ্চশিক্ষার সুযোগ
আপনার সংক্ষিপ্ত তালিকায় যেসব বিষয়ের নাম আছে, খোঁজ নিয়ে দেখুন, এই বিষয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার কী কী সুযোগ আছে? অনেক সময় এমন হয়, দেখবেন বাংলাদেশে একটা বিষয় নতুন। অথচ হার্ভার্ড, এমআইটি, অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওই বিষয়গুলো খুব গুরুত্বসহকারে পড়ানো হচ্ছে। বৈশ্বিক চিত্রটা দেখলে আপনি তুলনা করতে পারবেন। পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতেও সহায়ক হবে।
কী পড়ানো হয়
পছন্দ অনুযায়ী কোন কোন বিষয়ে পড়ার সুযোগ আছে, সেই তালিকা পেয়ে গেছেন। এবার খোঁজখবর নিয়ে দেখুন, এই বিষয়গুলোতে কী পড়ানো হয়, কারা পড়ান? প্রয়োজনে গুগলের সাহায্য নিন। এসব বিষয়ে যাঁরা পড়ছেন বা পড়াচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন। আপনি যা পড়তে চান, পাঠ্যক্রমে যদি তা না থাকে, তাহলে কিন্তু একটা ধাক্কা খাবেন।
কী কী দক্ষতা চাই
এখনকার সময়ের চাকরিজীবী বা উদ্যোক্তাদের মধ্যে যেসব দক্ষতা খোঁজা হয়, ভবিষ্যতেও যে চাহিদাটা একই রকম থাকবে তা নয়। ২০২৫ বা ২০৩০ সালেই দেখবেন, দৃশ্যপট বদলে গেছে। আমরা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা বলছি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের কথা বলছি। এসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভবিষ্যতে অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে মানুষের সৃজনশীলতা, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স) ইত্যাদি। কম্পিউটার বা রোবট আপনার সামনে সব তথ্য, বিশ্লেষণ হাজির করে দেবে। তথ্যগুলো আপনি কীভাবে কাজে লাগাচ্ছেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ভালো লাগা এবং ভবিষ্যতের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সম্ভাব্য কয়েকটি পড়ার বিষয়ের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করুন।
পরামর্শকের মতামত
বিজ্ঞজনের পরামর্শ নিন। হতে পারেন তিনি আপনার শিক্ষক, স্বজন বা জ্যেষ্ঠ কেউ। আপনার কী ইচ্ছা, পছন্দ, খোঁজখবর নিয়ে আপনি কী কী তথ্য পেয়েছেন, সবই তাঁর সামনে উপস্থাপন করুন। তারপর তাঁর মতামত জানুন। সম্পূর্ণভাবে তার মতামত আপনার পছন্দ না হলেও তাঁর পরামর্শ আপনার চিন্তা, চেতনা এবং ভাবনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
পরিবারের সমর্থন
আপনার আগ্রহ, লক্ষ্য, ভাবনাগুলোর কথা মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের বলুন। আপনার মতের সঙ্গে তাঁদের মত না-ও মিলতে পারে। কিন্তু যদি বোঝাতে পারেন যে আপনি যথেষ্ট খোঁজখবর করেছেন, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাহলে নিশ্চয়ই তাঁরা আপনার কথাকে অগ্রাহ্য করবেন না। ‘আমি এটাই পড়তে চাই’ না বলে কেন পড়তে চান, কী কী দিক বিশ্লেষণ করে আপনি সিদ্ধান্ত পৌঁছেছেন, তাঁদের সেটা দেখান। পরিবারের সদস্যরা আপনার এই চিন্তাধারা ও বিচক্ষণতাকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন এবং আপনার চিন্তার সঙ্গেই একমত হবেন। পরিবারের সাহায্য, সহযোগিতা ও শুভকামনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অবশেষে বিষয় নির্বাচন
সব ধাপ পেরিয়ে এসে এবার বিষয় নির্বাচন করুন। যখন আপনি আপনার গন্তব্য জেনে গেছেন, তখন আর পেছনে তাকানোর উপায় নেই। সমস্ত আবেগ, একাগ্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। নিজের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকুন এবং পছন্দের বিষয়ে সেরা হওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন। পাশাপাশি অন্য বিষয়গুলোর প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হোন। আপনার যেমন লক্ষ্য আপনার পছন্দের বিষয়ে সেরা হওয়া, ঠিক তেমনি অন্য আরেকজনের লক্ষ্য আরেকটি বিষয়ে সেরা হওয়া।
শেষ কথা
ভিড়কে অনুসরণ না করে দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি কাজে লাগিয়ে আপনার অনুপ্রেরণাকে অনুসরণ করুন।
আপনি যদি তথ্য বিশ্লেষণে ভালো হন, তাহলে এই সংক্রান্ত বিষয়গুলো পড়তে চেষ্টা করুন। যেমন অর্থনীতি, গণিত, পরিসংখ্যান বা ফাইন্যান্স ইত্যাদি। যদি উদ্ভাবন বা গবেষণায় আপনার ঝোঁক থাকে, তাহলে যেসব বিষয়ে সুযোগ আছে, যেমন জেনেটিকস ও বায়োটেকনোলজি, ফার্মাসি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন—এই বিষয়গুলো বেছে নিন। আবার তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহ থাকলে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, তথ্যপ্রযুক্তি, রোবটিকসের মতো বিষয়গুলো পড়তে পারেন।
আপনি যদি কৌশল ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্ব, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা অথবা বাজার বিষয়ে অভিজ্ঞ হতে চান, তাহলে কৌশল ও নেতৃত্ব, মার্কেটিং কিংবা আন্তর্জাতিক ব্যবসা নিয়ে পড়ুন। রাজনীতি, সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে যাঁদের আগ্রহ আছে, তাঁরা নির্দ্বিধায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, শিল্পকলা, ভাষা—এ ধরনের কোনো বিষয়ে ভর্তি হতে পারেন। যেকোনো বিষয়েই যদি আপনি ভালো হন, সচ্ছল জীবন যাপন নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।
এই সবকিছু বিবেচনা করে যদি স্নাতক পর্যায়ে বিষয় নির্ধারণ করেন, তাহলে আপনার জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শুধু আপনি একা নন, আপনার পরিবার এবং ভবিষ্যতে আমাদের দেশ ও সমাজও ভীষণভাবে উপকৃত হবে।