কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়
অস্বাভাবিক ‘সুবিধায়’ শিক্ষকদের পদোন্নতি
এক বছরের মধ্যে কোনো জার্নালে সাতটি প্রকাশনা থাকলেই প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ। সহযোগী অধ্যাপক হতেও রেয়াত সুবিধা।
এক বছরের মধ্যে কোনো জার্নালে সাতটি প্রকাশনা বেরোতে হবে। তবেই পাওয়া যাবে দুই বছরের রেয়াত (ছাড়) সুবিধা। এই সুবিধায় মিলবে এক বছরের মধ্যে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন রেয়াত সুবিধা আছে অন্যান্য পদেও।
এরই মধ্যে কয়েকজন শিক্ষক এই সুবিধা নিয়ে পদোন্নতি পেয়েছেন। তবে শিক্ষকদেরই একটি অংশ বলছেন, এত অল্প সময়ে কারও পক্ষেই ভালো মানের সাতটি গবেষণা প্রবন্ধ কোনো স্বনামধন্য জার্নালে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অনেকেই নিজ বিভাগের জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ করেও এই সুবিধা নিচ্ছেন, যা ভালো উদাহরণ নয়।
এই সুবিধায় নতুন করে অন্তত ছয়জন শিক্ষককে বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতির সুযোগ দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে আলোচনা করতে আজ শনিবার ডাকা হয়েছে সিন্ডিকেটের বৈঠক।
ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট শিক্ষক প্রায় ২০০ এবং কর্মকর্তা প্রায় ১০০ জন।
উপাচার্য এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমানও মনে করেন, বিদ্যমান সুবিধা অনেক বেশি নমনীয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই নিয়ম তাঁর আসার আগে থেকেই ছিল। এটি দেখে তিনিও অবাক হন। কারণ, বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সহজ
নিয়ম নেই। তবে একবার সুবিধা দিয়ে সেটি বাদ দেওয়াও কঠিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতি নীতিমালার সাধারণ নিয়মে বলা হয়েছে, পিএইচডি বা এমফিল ডিগ্রিধারী ছাড়া কেবল স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী কোনো প্রভাষককে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার জন্য তিন বছরের শিক্ষকতা বা গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। একই সঙ্গে স্বীকৃত জার্নালে ন্যূনতম একটি প্রকাশনা থাকতে হবে। কিন্তু পরে আবার বলা হয়েছে, আপগ্রেডেশনের (পদোন্নতি) ক্ষেত্রে নির্ধারিত প্রকাশনার (প্রভাষকের ক্ষেত্রে একটি) বাইরে অতিরিক্ত তিনটি প্রকাশনার জন্য এক বছরের এবং অতিরিক্ত ছয়টি বা তার বেশি প্রকাশনার জন্য সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত ‘রেয়াত’ সুবিধা দেওয়া যাবে।
এর অর্থ হলো, কেউ প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়ে এক বছরের মধ্যে নির্ধারিত একটির সঙ্গে আরও ছয়টি (মোট সাতটি) প্রকাশনা কোনো জার্নালে প্রকাশ করতে পারলেই সহকারী অধ্যাপক হতে পারবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই সুবিধা নিয়ে ফিন্যান্স বিভাগের একজন শিক্ষক এক বছরের মাথায় সহকারী অধ্যাপক হয়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন ২০১৮ সালের নভেম্বরে। আর গত বছরের নভেম্বরেই সহকারী অধ্যাপক হয়েছেন। একইভাবে পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষকও এই সুবিধায় সহকারী অধ্যাপক হয়েছেন। তিনি তাঁর নিজ বিভাগ থেকে জার্নাল বের করে সেখানে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এমনকি একই বিষয়ে তাঁর দুটি প্রকাশনা বেরিয়েছে একই সংখ্যায়।
সহকারী থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য সাধারণ নিয়ম হলো, শিক্ষকতার ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সঙ্গে লাগবে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে তিনটিসহ মোট চারটি প্রকাশনা। কিন্তু এখানেও সেই রেয়াত সুবিধা নিয়ে আট বছরের মধ্যেই সহযোগী অধ্যাপক হওয়া যায়। অবশ্য পিএইচডি বা এমফিল ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে নিয়ম আলাদা।
এই প্রক্রিয়ায় এখন মানবসম্পদ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বাংলাসহ কয়েকটি বিভাগে অন্তত ছয়জন সহকারী অধ্যাপককে সহযোগী অধ্যাপক করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বাছাই বোর্ডও হয়ে গেছে। এখন সিন্ডিকেটে সেটি অনুমোদন হলেই চূড়ান্ত হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, একজন সহকারী অধ্যাপক পিএইচডি করে সাত বছরের মধ্যে সহযোগী অধ্যাপক হবেন। আরেকজন কোনোরকমে কয়েকটি প্রকাশনা প্রকাশ করেই রেয়াত সুবিধায় আট বছরের মধ্যে সহযোগী অধ্যাপক হয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে কার্যত পিএইচডি বা উচ্চতর গবেষণাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তিনি মনে করেন, এই রেয়াত সুবিধা সংশোধন করা উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েই আপগ্রেডেশন নিয়ে এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটছে, যা নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। এ জন্য ইউজিসি আগামী মাসেই একটি সাধারণ নির্দেশিকা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পাঠাচ্ছে।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক নিয়ম। এ জন্য নিজেদের মতো এগুলো করা হচ্ছে। তাই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা থাকা দরকার। এ বিষয়ে ইউজিসি সমন্বিত নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালাও করেছিল, কিন্তু সেটি মানতে চায় না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এটি হওয়া দরকার।