প্রাথমিক শিক্ষা
পিটিআইয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে উল্টো পথে শিক্ষা প্রশাসন
দেড় বছরের প্রশিক্ষণ কোর্স সংকোচন করে ১০ মাস হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জানুয়ারিতে শুরু হয়নি প্রশিক্ষণ।
শিক্ষার্থীদের গুণগত শিক্ষা দিতে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে আসছেন শিক্ষাবিদেরা। এই দক্ষতা বাড়ানোর অন্যতম পথ হলো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে উল্টো পথে হাঁটছে শিক্ষা প্রশাসন।
শিক্ষাবিদদের পরামর্শে ও জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশের সঙ্গে মিল রেখে পিটিআইগুলোতে ১৮ মাসের কোর্স চালু করা হয়েছিল। একে সংকুচিত করে ১০ মাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন। এমনভাবে এই ১০ মাস নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে কার্যত পিটিআইয়ের প্রশিক্ষণ হবে ৬ মাস।
এখন শিক্ষকেরা শিক্ষা দেওয়ার বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান ছাড়াই শিক্ষকতায় প্রবেশ করছেন। সেখানে ১০ মাসের কোর্সে কীভাবে এই জ্ঞান দেওয়া হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে।
শুধু তা–ই নয়, বিদ্যমান শিক্ষক শিক্ষা কর্মসূচিকে গুরুত্বহীন করতে চলমান ‘ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড)’ কোর্সের নামই পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে প্রাথমিক শিক্ষকদের এই প্রশিক্ষণের নাম হবে মৌলিক প্রশিক্ষণ। যে সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে, ‘পরিমার্জিত প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ শিক্ষাক্রম স্টিয়ারিং কমিটি’ নামের সেই সভায় উপস্থিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হ্যাপি কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, চলমান কোর্সের মেয়াদ কমানোর যৌক্তিক কারণ নেই। তিনি মেয়াদ এক বছর করার সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু তা–ও রাখা হয়নি।
অন্যদিকে শিক্ষা প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোতে (পিটিআই) নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে আইনের লঙ্ঘন উল্লেখ করে ইতিমধ্যে তাঁদের পক্ষ থেকে আইনি নোটিশও দেওয়া হয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রতিবছরের জানুয়ারিতে যেখানে পিটিআইয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়, সেটিও এখন শুরু হচ্ছে না। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চলমান কোর্সের কোনো দুর্বলতা থাকলে সেটি পরিমার্জন করে আরও উন্নয়ন করা যেতে পারে। কিন্তু তা না করে প্রাথমিকের শিক্ষা প্রশাসন উল্টো পথে যাচ্ছে। তাঁরা মনে করছেন, এর পেছনে হয়তো ‘ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য’ আছে। এটি বাস্তবায়িত হলে প্রাথমিক শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জায়গাটিও সংকুচিত হবে।
অবশ্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেছেন, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং ধারাবাহিক সভা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বছর থেকে এটি বাস্তবায়ন করা হবে।
বর্তমানে সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। এগুলোয় মোট শিক্ষক আছেন চার লাখের মতো।
বর্তমানে দেশের ৬৭টি পিটিআইয়ের অধীনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এটি সব শিক্ষকের জন্যই বাধ্যতামূলক। একসময় এই প্রশিক্ষণ কোর্সটি ছিল এক বছর মেয়াদি। তখন এর নাম ছিল সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন (সিইনএড)। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে হওয়া জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০–এ এই কোর্সের মেয়াদ এক বছর থেকে বাড়িয়ে ১৮ মাস (দেড় বছর) করার কথা বলা হয়। এরপর শিক্ষানীতির সুপারিশ ও শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ২০১২ সালে প্রথমে সাতটি বিভাগীয় শহরে অবস্থিত পিটিআইয়ে পরীক্ষামূলকভাবে দেড় বছর মেয়াদি কোর্স চালু করা হয়। গুরুত্ব বিবেচনা করে এই কোর্সের নাম দেওয়া হয় ‘ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন’। এভাবে পর্যায়ক্রমে ২০১৯ সাল থেকে দেশের সব কটি পিটিআইয়ে এই কোর্স শুরু করা হয়। পিটিআইগুলোর এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমটির কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করছে ময়মনসিংহে অবস্থিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, গত বছরের মাঝামাঝি থেকে পিটিআইয়ের মাধ্যমে চলমান শিক্ষক শিক্ষা কোর্সকে সংকুচিত করার তৎপরতা শুরু হয়। তাদের বক্তব্য, দেড় বছরের প্রশিক্ষণ কোর্স হলে অনেক সময় বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকসংকট হয়। আবার এত শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়াও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ জন্য প্রশিক্ষণের মেয়াদ কমানো দরকার। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তার আগ্রহের কারণেই মূলত এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২২ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ‘পরিমার্জিত প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ শিক্ষাক্রম স্টিয়ারিং কমিটির’ দ্বিতীয় সভায় প্রশিক্ষণের মেয়াদ ১০ মাস করার সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ৬ মাস প্রশিক্ষণ হবে পিটিআইয়ে এবং বাকি ৪ মাস প্র্যাকটিস টিচিং। মানে ৪ মাসের প্রশিক্ষণকাজটি হবে মূলত বিদ্যালয়ে।
ওই সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, সভায় উপস্থিত নেপের মহাপরিচালক মো. শাহ আলম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের অধ্যাপক হ্যাপি কুমার দাস এবং ঢাকা পিটিআইয়ের সুপারিনটেনডেন্ট মো. কামরুজ্জামান কোর্সটিকে এক বছর করার সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু সেটাও করা হয়নি। বরং আরও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কী বলেন শিক্ষক ও প্রশিক্ষকেরা
ঢাকার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক প্রথম আলোকে বললেন, দেড় বছর মেয়াদি ডিপিএড কোর্সটির শিক্ষাক্রম খুবই যুগোপযোগী। এটি সংকুচিত করলে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য খুবই ক্ষতিকর হবে। তাঁর অভিমত, শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হওয়ার আগেই এ ধরনের শিক্ষা কোর্সের ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক করলে আরও বেশি ভালো হবে।
অবশ্য কোনো কোনো শিক্ষক আছেন, যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের বিপক্ষে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখন শিক্ষকেরা শিক্ষা দেওয়ার বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান ছাড়াই শিক্ষকতায় প্রবেশ করছেন। সেখানে ১০ মাসের কোর্সে কীভাবে এই জ্ঞান দেওয়া হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে।