ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন পরিবেশে ১১২ দিন পর ক্লাসে শিক্ষার্থীরা
দীর্ঘ ১১২ দিন পর আবার শ্রেণিকক্ষে ফিরছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে আজ রোববার শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। এর কারণ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হলগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন হলে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আসন বণ্টনের কাজটি অনেকটাই সম্পন্ন করা হয়েছে।
প্রথম বর্ষ ছাড়া অন্য বর্ষগুলোর শ্রেণি কার্যক্রম (ক্লাস) শুরু হবে আজ। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হবে ৩০ সেপ্টেম্বর। ক্লাস শুরুর আগে গতকাল শনিবার ১০টি ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সবার সহযোগিতা চাওয়া হয়। অন্যদিকে ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতারা ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরেন। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং বিভিন্ন হল সংসদ নির্বাচনের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান।
শিক্ষার্থীরা কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছেন। শিক্ষার্থীদের সাদরে বরণ করার জন্য শিক্ষকেরা অপেক্ষা করছেন।নিয়াজ আহমেদ খান উপাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খানের কার্যালয়ে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত সভায় অংশ নেন সহ-উপাচার্য মামুন আহমেদ ও সায়মা হক বিদিশা, কোষাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ। সভার প্রথম পর্বে অংশ নেয় গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন ও জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। দ্বিতীয় পর্বে ছিলেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ), ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ও ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তবে ছাত্রশিবিরকে এই সভায় ডাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিভিন্ন বাম ছাত্রসংগঠনের নেতারা। কিন্তু মতবিনিময় সভায় ছাত্রনেতাদের প্রশ্নের কোনো জবাব উপাচার্য দেননি বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
মতবিনিময় সভার বিষয়ে উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার অংশ হিসেবে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তারা নানা ধরনের সংস্কার প্রস্তাব ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছিল।’
দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা নিয়ে যে আলোচনা চলছে, সে বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘এখন আমাদের প্রধান চিন্তা হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা। এই মুহূর্তে ছাত্ররাজনীতির বিষয়টা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলতে চাই না।’
শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে কি না, এমন প্রশ্নে উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ বলেন, শিক্ষার্থীরা কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছেন। শিক্ষার্থীদের সাদরে বরণ করার জন্য শিক্ষকেরা অপেক্ষা করছেন। শিক্ষার পরিবেশ এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা। এ জন্য সব মহলের সহযোগিতা প্রয়োজন। অনেক রকম দ্বন্দ্ব-টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। কঠিন যাতনা অতিক্রম করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রোববার (আজ) শ্রেণিকক্ষে ফিরবেন। তাঁদের ট্রমাকে (মানসিক আঘাত) কীভাবে সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়, সে জন্য ‘মনোবৈঠক’ নামে একটি পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা। পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক-শিক্ষকসহ বিভিন্ন পর্যায়ে দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য কাজ করছেন তাঁরা। এখনো কয়েক জায়গায় সমস্যা আছে। তবে আশা করা যাচ্ছে যে এটা ঠিক হয়ে যাবে।
নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার আপাত অবসান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এই মুহূর্তে কোনো ছাত্রসংগঠনের একক আধিপত্য নেই। গণরুম-গেস্টরুমের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থারও আপাত অবসান হয়েছে। আগে বিভিন্ন হলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগের অনুগত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের কাছে। গণ–অভ্যুত্থানে তারা ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়েছে।
ঈদুল আজহার আগে গত ২ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি শুরু হয়। ছুটি শেষে ১ জুলাই শ্রেণি কার্যক্রম তথা ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সর্বজনীন পেনশনের নতুন স্কিম (কর্মসূচি) ‘প্রত্যয়’ প্রত্যাহারের দাবিতে ওই দিন থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পৃথক আন্দোলনে গত জুলাইয়ে কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এর ফলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন একপর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় এবং গণ–অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার পর ১১২ দিন পর আজ আবার ক্লাসে ফিরতে যাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছুটি শুরু হয়, তখন উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ১০ আগস্ট পদত্যাগ করেন তিনি। এর আগে পদত্যাগ করেন প্রক্টর। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২৭ আগস্ট নতুন উপাচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর প্রক্টরসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নতুন নিয়োগ হয়।
নতুন প্রশাসন শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করার ব্যাপারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। তবে গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে এক যুবককে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্রুত বিষয়টি তদন্ত করে। পাশাপাশি হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আট শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁদের মধ্যে ছয়জনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জবরদস্তি থেকে মুক্ত পরিবেশে
গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ ছিল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। হল ও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের ‘সমান্তরাল প্রশাসন’ কার্যত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত। বিশেষ করে ছাত্রদের ১৩টি হল ছিল ছাত্রলীগের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। হলের কোন কক্ষে কে থাকবেন, ত ঠিক করতেন ছাত্রলীগের নেতারা। অছাত্র হয়েও তাঁদের অনেকে বছরের পর বছর হলের কক্ষ দখল করে থাকতেন।
আবাসন-সংকটের কারণে গণরুমে গাদাগাদি থাকতে হতো প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের। গণরুমগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল ছাত্রলীগের নেতাদের কাছে। এই নিয়ন্ত্রণ সংহত করতে হলগুলোতে নিয়মিত সন্ধ্যার পর বা রাতে ‘গেস্টরুম’ করানো হতো প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের। হলগুলোর অতিথিকক্ষে ‘আদবকায়দা’ শেখানোর নামে মানসিক নিপীড়নকে (কখনো কখনো শারীরিকও) বলা হতো ‘গেস্টরুম করানো’। পাশাপাশি মধুর ক্যানটিনে ছাত্রলীগের নিয়মিত ‘হাজিরা’ কর্মসূচি থাকত। গেস্টরুম ছিল ছাত্রলীগের ‘আদালত’। সেখানে জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের সালাম না দেওয়া ও ছাত্রলীগের ‘নিয়মকানুন’ না মানার অভিযোগে ‘বিচারের’ মুখোমুখি হতে হতো কনিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের।
নির্যাতন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, প্রশ্নপত্র ফাঁসে যুক্ত থাকা, গণরুম-গেস্টরুমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যবহার, শিবিরসহ নানা অপবাদে শিক্ষার্থীদের পেটানো—ছাত্রলীগের সাড়ে ১৫ বছরের একচ্ছত্র আধিপত্যে এসব ছিল নিয়মিত ঘটনা।
প্রথম আলোর হিসাবে, গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় ছিনতাই ও মারধরের অন্তত আটটি ঘটনায় জড়িত ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এসব ঘটনায় ছয়টি মামলা হয়। একই সময়ে অন্তত পাঁচটি চাঁদাবাজির ঘটনায় নাম আসে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। অন্যদিকে গত বছর ক্যাম্পাসে নিজেদের মধ্যেই অন্তত ১৩ বার সংঘর্ষে জড়ান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। হলের কক্ষ দখল, প্রভাব বিস্তার, ফুটপাতে দোকান বসানো নিয়ে অন্তর্কোন্দল—এসব ছিল সংঘর্ষের কারণ।
গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় অন্তত আটবার প্রতিপক্ষ সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। একই সময়ে ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতনের ঘটনা ঘটে অন্তত ছয়টি।
ছাত্রলীগের অপকর্ম বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছিল অনেকটাই নীরব। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখেও না দেখার ভান করে নিষ্ক্রিয় থেকেছে তারা। ক্যাম্পাস ও হলে যেমন ছাত্রলীগের একাধিপত্য ছিল, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সব পদ ছিল আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের দখলে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এর আগে ১৭ জুলাই ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো করে হলগুলোতে উঠে যান। পরে প্রশাসনিকভাবে আবেদন আহ্বান করে আসন বণ্টন করার কাজ শুরু হয় হলগুলোতে। পাশাপাশি উপাচার্য বিভিন্ন হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সভা করে তাঁদের কথা শুনেছেন। এর মধেই ১০ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে গণরুম বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
গতকাল বিজয় একাত্তরসহ চারটি হলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন আর কক্ষ দখলের প্রতিযোগিতা নেই। অছাত্ররা হল ছাড়ায় কনিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা আসন পেয়েছেন। হলের ক্যানটিন ও দোকানে চাঁদাবাজি এবং ‘ফাও’ খাওয়ার ঘটনাও শোনা যায়নি। এসব হলের শিক্ষার্থীরা বলছেন, গণরুম-গেস্টরুমের বিভীষিকা এখন আর নেই।
ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্ররাজনীতির নামে এত দিন যে অপকর্মগুলো হয়েছে, সেগুলো ঠেকানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত একটি নীতিমালা করা। কীভাবে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা যায়, বিষয়টি নীতিমালায় থাকতে পারে।