‘You don’t have to be a mathematician to have a feel for numbers’ —John Forbes Nash.
গণিতের ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত মণীষীদের একজন পিথাগোরাস সাহেবের অনেক অনেক উদ্ভাবনা গণিতের যে বিষয়কে ঘিরে, সেই সংখ্যাকে নিয়ে আজ আমরা জানব। গণিত ইশকুলের আজকের লেখা পড়তে অথবা বুঝতে যে গণিত জানা লাগবে না, সেটা হয়তো ওপরের উক্তিটি থেকেই তোমরা বুঝে গিয়েছ।
তো এই সংখ্যা নিয়ে এত কী আছে জানার? আশা করছি তোমাদের জন্য লেখা এই পুরো সিরিজ পড়া শেষে সংখ্যাকে কিংবা সংখ্যার ওপর মানুষের ঘুটুরঘুটুর নিয়ে তোমাদের জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যাবে।
প্রয়োজন ব্যতীত মানুষ কিছুই করেনি, করে না, আর করবেও না। এটা চিরন্তন সত্য। সংখ্যার আবির্ভাবও আসলে এই সত্যকে কেন্দ্র করে। গণনা করার প্রয়োজনীয়তা থেকে ধীরে ধীরে চলে আসে অঙ্ক, সংখ্যা। তবে শুরুর দিকে সংখ্যা নিয়ে মানুষের ধারণা বেশ অস্পষ্ট ছিল। সংখ্যাগুলো সর্বদাই বস্তুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকত। যেমন একটা আম, একজোড়া ইলিশ, দুটো হাত, এক হাঁড়ি রসগোল্লা ইত্যাদি।
আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ১০০-২০০ বছর আগেও সংখ্যা নিয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার হটেনটট আদিবাসীর কথা। তাদের ভাষায় শুধু এক থেকে চার পর্যন্ত সংখ্যা ছিল এবং চারের চেয়ে বড় সব সংখ্যাই তাদের ভাষায় অনেক! অর্থাৎ তুমি তাদের পাঁচটা বোঝাতে চাইলেও বলতে হবে অনেক, আবার পাঁচ হাজারটা বোঝাতে চাইলেও বলতে হবে অনেক!
আবার অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী কামিলারাই গোত্রের মানুষ তিনের চেয়ে বড় কোনো সংখ্যা বোঝাতে সেই সংখ্যাকে এক থেকে তিন পর্যন্ত অঙ্কগুলোর যোগফল আকারে প্রকাশ করত। তাদের অঙ্ক ছিল মাল (এক), বুলান (দুই), গুলিবা (তিন)। তাই চারকে তারা বলত বুলান-বুলান (দুই+দুই=চার); পাঁচকে বুলান-গুলিবা (দুই+তিন=পাঁচ) আর ছয়কে বোঝাতে গুলিবা-গুলিবা (তিন+তিন=ছয়)। এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে কিন্তু! খেয়াল করে দেখলে তুমি হয়তো বুঝতে পারবে যে তুমি চাইলে এই তিনটি অঙ্ককে ব্যবহার করে সব স্বাভাবিক সংখ্যায় যেতে পারবে।
এখন প্রশ্ন চলে আসে, কামিলারাই গোত্রের ভাষায় এক শ কিংবা এক হাজারকে কীভাবে বলা হতো? কতগুলো লিখবে তুমি এভাবে? এক হাজার লিখতে তোমার মোটামুটি ৩৩৩ বার গুলিবা আর ১ বার মাল লিখতে হবে। খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে, হটেনটট কিংবা কামিলারাই গোত্রের গণনাপদ্ধতি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু এতে তাদের কিছুই আসে যায়নি। কারণ, এক শ পর্যন্ত গণনা করার দরকারই হয়তো তাদের ছিল না। তবে নবপোলীয় যুগে উন্নত সভ্যতাগুলোর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন পড়ল আরও উন্নত গণনাপদ্ধতির।
সেই উন্নত গণনাপদ্ধতি খুঁজতে গিয়েই মিসরীয়রা আবিষ্কার করে ফেলল একটা মজার সংখ্যাপদ্ধতির। প্রাচীন মিসরে ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থাপত্য এবং জীবনযাত্রায় প্রভূত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত গণনাপদ্ধতির অনেক প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। আর সেই প্রয়োজনীয়তা থেকে বিকশিত হয়েছিল মিসরীয় সংখ্যাপদ্ধতি। প্রকাণ্ড পিরামিডগুলো নির্মাণের সময় হাজার হাজার শ্রমিকের খোরাক এবং বিপুল পরিমাণ নির্মাণসামগ্রীর পাকা হিসাব রাখতে তারা সংখ্যাপ্রতীক ব্যবহার করত। তবে ধারণা করা হয়, মিসরীয়দের সংখ্যাপদ্ধতির সূচনা হয়েছিল পিরামিডেরও আগে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের দিকে।
কিন্তু আমাদের এখনকার মতো ছিল না মিসরীয়দের সেই সংখ্যাপদ্ধতি। সেখানে ছিল না শূন্যের ব্যবহার। ছিল মাত্র পনেরোখানা ছবি, যেগুলোর প্রথম ৯টা চিহ্ন দিয়ে তারা ১ থেকে ৯ পর্যন্ত আর বাকি ছয়টা চিহ্ন দিয়ে দশের ছয় ঘাত পর্যন্ত (১০১ থেকে ১০৬) সূচকীয় গুণিতক বুঝিয়েছে। তাদের প্রতীকগুলো খুব অদ্ভুত ছিল বটে। তোমরা ওপরের ছবিতে দেখলেই বুঝতে পারবে। একটা দাগ দিয়ে তারা ১ বুঝিয়েছে। এবার ৯ পর্যন্ত এভাবেই গিয়েছে। এটাকে তারা বলত Line! এরপর আরও দাগ দিয়ে ১০, ১১, ১২ বোঝাতে পারত। কিন্তু তারা সেটা না করে ১০ বোঝাতে Loop, ১০০ বোঝাতে Rope, ১০৩ বোঝাতে Flower, ১০৪ বোঝাতে Finger, ১০৫ বোঝাতে Tadpole এবং ১০৬ এর জন্য নির্বাচন করেছে God প্রতীককে। এখন ধরো তুমি মিসরীয় পদ্ধতিতে ১২৪২৭ লিখতে চাও। এ ক্ষেত্রে তোমাকে ১টা ১০০০০ বা Finger, ২ টা ১০০০ বা Flower, ৪টা ১০০ বা Rope, ২টা ১০ বা Loop এবং ৭টা ১ বা Line পাশাপাশি আঁকতে হবে। ফলে এদের যোগফল হবে আমাদের সংখ্যাটা অর্থাৎ ১২৪২৭! নিচের চিত্রে লক্ষ করলেই বুঝতে পারবে ব্যাপারটা আসলে দেখতে কেমন হবে!
আজ আর বেশি এগোব না। হটেনটট, কামিলারাই এবং মিসরীয়দের সংখ্যাপদ্ধতি নিয়ে তোমাদের একটা ধারণা দিলাম। আগামী পর্বে ব্যাবিলনীয়, গ্রিক ও রোমান পদ্ধতি এবং মায়া সভ্যতার গণনাপদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করে প্রাচীন সংখ্যাপদ্ধতির পালা সমাপ্তি করে চলে যাব আধুনিকতায়!