রেস্তোরাঁর ব্যবসা ছেড়ে হারুকি মুরাকামি যেভাবে লেখক হলেন

সমকালীন বিশ্বসাহিত্যের প্রধান এক লেখক জাপানের হারুকি মুরাকামি। ছাত্রজীবনেই ঢুকে পড়েছিলেন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়। লাভের মুখও দেখেছিলেন। তারপরও কেন সেখান থেকে বেরিয়ে সাহিত্যকর্মকে পেশা হিসেবে নিলেন, সেই গল্প তিনি লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথা হোয়াট আই টক অ্যাবাউট, হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং-এ। বইটি থেকে কিছু অংশ থাকল আজ

হারুকি মুরাকামি
ছবি: সংগৃহীত

শুরু জ্যাজ ক্লাব দিয়ে

বেশ আগের কথা। তখনো ছাত্রজীবন শেষ হয়নি। [টোকিওর] সেন্দাগায়া স্টেশনের কাছে আমার একটা জ্যাজ ক্লাব ছিল। স্নাতকের পর কোকুবাঞ্জি স্টেশনের দিকে আরেকটা ক্লাব চালু করি। তিন বছর সেখানে ব্যবসা করার পর ভবনটি ভেঙে ফেলায় আবার বদলাতে হয় ক্লাবের জায়গা। টোকিও শহরের কাছে ছোট একটা জায়গায় নতুন করে ক্লাব সাজাই। ক্লাবের অন্দরে বড়সড় গ্র্যান্ড পিয়ানো বসানোর পর কয়েকজন মানুষের বসার ব্যবস্থা কোনোরকমে হয়ে যায়। দিনের বেলা কফি বিক্রি করতাম, সন্ধ্যার পর ওটাই হয়ে যেত বার। হালকা খাবারও পাওয়া যেত। আর ছুটির দিনগুলোয় বসত জ্যাজের আসর। যে সময়ের কথা বলছি, ওই সময় টোকিওতে এমন জ্যাজ ক্লাব বলতে গেলে ছিল না। তাই অল্প দিনেই ক্লাবের নামডাক শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

পরিচিতজনেরা শুরুতেই হুঁশিয়ার করেছিল, এমন বিরল জ্যাজ ক্লাব চালু করার উদ্যোগ মাঠে মারা যাবে। শখ আর ঝোঁকের মাথায় ব্যবসায় নেমে সফল হতে পারব না, এ বিষয়ে অনেকেই নিশ্চিত ছিল। কিন্তু উল্টো তাদের ভবিষ্যদ্বাণীই মাঠে মারা পড়ল। ব্যবসার বিষয়ে আমি একেবারেই কাঁচা ছিলাম, তা ঠিক। কিন্তু ব্যর্থতা বলে যে কিছু আছে, এটা আমি মানতাম না। নিজের যা কিছু আছে, এর সবটাই আমি আমার শখ, স্বপ্ন ও আগ্রহের পেছনে উজাড় করে দিতাম। অনেক ছোট বয়স থেকে আমার একটা গুণ বরাবরই ছিল। আমি প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারতাম, রাতদিন খাটতে পারতাম। রেসের ঘোড়া না, আমি ছিলাম মালবাহী ঘোড়া।

চেপে বসল লেখক হওয়ার সাধ

ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে যেতাম। কয়েক বছরের হাড়ভাঙা খাটুনির পর আস্তে আস্তে লাভের মুখ দেখতে শুরু করি। বয়স যখন ত্রিশের কোটা ছুঁই ছুঁই, প্রথমবারের মতো নিজের প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগের সামর্থ্য অর্জন করি। একটু যেন নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাই। ধীরে ধীরে ব্যবসার জন্য নেওয়া ঋণও সব শোধ করে দিই। কাঁধ থেকে একেক করে যেন বোঝা হালকা হতে শুরু করে। এক পা করে উঠতে উঠতে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে অল্প দিনেই বেশ ওপরে উঠে যাই। নিজের ওপর বিশ্বাস জন্মে, এত কিছু সহ্য করে যখন এত দূর আসতে পেরেছি, তখন জীবনের আর সব সংগ্রামই ঠিক সামলে নেব। আর কোনো বাধাই আমাকে দমাতে পারবে না। কিন্তু সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে যত ওপরে উঠতে থাকি, বোঝাগুলো যত কমতে থাকে, ততই আমাকে নতুন কিছু শুরু করার আকাঙ্ক্ষা তাড়িত করে। ওই তাড়না থেকেই একদিন হুট করে লেখক হওয়ার ভাবনা পেয়ে বসে।

ঠিক ওই মুহূর্তের আকাশের রং, রোদে তেতে ওঠা ঘাসের ওম আর ব্যাট–বল ছুঁয়ে গেলে যে অদ্ভুত আওয়াজটা হয়—সব আমার স্পষ্ট মনে আছে। মনে হচ্ছিল, আকাশ থেকে টুপ করে যেন লেখার চিন্তাটা আমার ওপর এসে পড়ল, আর আমিও সেটা খুশি মনে গ্রহণ করলাম। কারণ, এর আগে কখনোই সাহিত্যিক হওয়ার কোনো পরিকল্পনা বা আগ্রহ আমার ছিল না। হঠাৎ করেই যেন লেখালেখির তীব্র আকাঙ্ক্ষা ভর করে।

স্পষ্ট মনে আছে, দিনটা ছিল ১৯৭৮ সালের ১ এপ্রিল। জিঙ্গু স্টেডিয়ামের ঘাসের গ্যালারিতে গা এলিয়ে খেলা দেখছিলাম। আকাশ ছিল একেবারে পরিষ্কার। বসন্তের উতলা বাতাসে খেলা থেকে মনটা বারবার আকাশের দিকে চলে যাচ্ছিল। কখনো খেলা দেখছিলাম, কখনো আকাশ। আর ঠিক তখনই মন থেকে যেন একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম, ‘আমি লেখালেখির চেষ্টা করলেও তো পারি।’ ঠিক ওই মুহূর্তের আকাশের রং, রোদে তেতে ওঠা ঘাসের ওম আর ব্যাট–বল ছুঁয়ে গেলে যে অদ্ভুত আওয়াজটা হয়—সব আমার স্পষ্ট মনে আছে। মনে হচ্ছিল, আকাশ থেকে টুপ করে যেন লেখার চিন্তাটা আমার ওপর এসে পড়ল, আর আমিও সেটা খুশি মনে গ্রহণ করলাম। কারণ, এর আগে কখনোই সাহিত্যিক হওয়ার কোনো পরিকল্পনা বা আগ্রহ আমার ছিল না। হঠাৎ করেই যেন লেখালেখির তীব্র আকাঙ্ক্ষা ভর করে। কী লিখব, কীভাবে লিখব, কখন লিখব—কিছুই জানতাম না। শুধু উপলব্ধি করলাম আমাকে লিখতে হবে। ওই দিন বাড়ি ফিরে যখন টেবিলে লেখার জন্য বসলাম, খেয়াল করলাম, আমার কাছে একটা ভালো কলম পর্যন্ত নেই! সঙ্গে সঙ্গে দোকানে গিয়ে ভালো কাগজ আর পাঁচ ডলার দিয়ে একটা ঝরনা কলম কিনে এনেছিলাম। এই ছিল সাহিত্যজীবনের প্রথম বিনিয়োগ।

ওই বসন্তে আমি যে উপন্যাস লেখা শুরু করি, ওটা শেষ হয় শরতে। ২০০ পৃষ্ঠার হাতে লেখা ওই পাণ্ডুলিপি যেন আমার জীবনের এক অন্যতম অর্জন। ওই পাণ্ডুলিপি নিয়ে কী করব, এর ভবিষ্যৎ কী—কিছুই জানতাম না তখন। ভীষণ উত্তেজনায় লেখা শেষ হতেই আমি ওই পাণ্ডুলিপির দ্বিতীয় কোনো কপি না বানিয়ে এক সাহিত্য সাময়িকী বরাবর পোস্ট করে দিই। এত কিছু ওই সময় মাথাতেই আসেনি। লেখা ছাপা হলো কি না বা ওটা হারিয়ে গেলে কী হবে—এসব ভাবার সময় কই! আমি যে একটা উপন্যাস লিখে শেষ করতে পেরেছি, এটাই বিরাট রোমাঞ্চের বিষয় ছিল। পরে অবশ্য হেয়ার দ্য উইন্ড সিং নামে উপন্যাসটি ছাপা হয়েছিল। দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। তবে আমার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছিল পরিচিতজনেরা।

ব্যবসায় ইতি, পেশা হবে লেখালেখি

ব্যবসা আর লেখালেখি—দুটোই চালিয়ে যেতে থাকি। দ্বিতীয় উপন্যাস পিনবল, ১৯৭৩ লেখার আগে কিছু ছোটগল্প লিখেছিলাম, অনুবাদও করেছিলাম। কিন্তু এক হাতে লেখালেখি আর ক্লাব চালানো বেশ কঠিন। তিন বছর ধরে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত আমি জ্যাজ ক্লাবে সময় দিতাম। ক্লাব বন্ধ করার পর দিনের হিসাব–নিকাশ আর গোছগাছ করতাম রাত তিনটা পর্যন্ত। এরপর ঘুম না আসা পর্যন্ত লেখালেখি করতাম। এমনও হয়েছে, রাত থেকে ভোর হয়ে যাওয়ার পরও লিখে গিয়েছি। ওই সময় মনে হতো আমি একসঙ্গে দুজন মানুষের জীবন যাপন করছি। কিন্তু কোনোটিতেই নিজের সবটুকু দিতে পারছি না।

সাহিত্যসৃষ্টি উপভোগ করছিলাম। কিন্তু দু–এক ঘণ্টা সময় নিয়ে লেখালেখি করে ঠিক তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। তাই অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম, ব্যবসার পাট চুকিয়ে পুরোদমে সাহিত্যকর্মে মন দেব। ওই সময় জ্যাজ ক্লাবটা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছিল, ভালো আয় হতো। তাই কাছের মানুষেরা সবাই আমার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করল। অনেকে বলল, ‘ব্যবসা তো ভালো চলছে। একেবারে বন্ধ না করে তুমি বরং অন্য কাউকে ক্লাবের দায়িত্ব দিয়ে বছর দুয়েকের জন্য বিরতি নাও।’ সবাই ধরে নিয়েছিল সাহিত্যকর্ম করে আমি সংসার চালাতে পারব না। কিন্তু আমি কখনো অন্যের কথা শুনে নিজের পরিকল্পনা থেকে সরে দাঁড়াইনি।

লেখালেখির বেলাতেও তা–ই হলো। জ্যাজ ক্লাব বিক্রি করে চলে গেলাম নতুন শহরে। আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম, ‘লেখালেখির জন্য দুই বছর অন্য সব কাজ থেকে ছুটি নিতে চাই। যদি এ যাত্রায় ব্যর্থ হই, আমরা আবার অন্য কোথাও নতুন একটা ক্লাব খুলব। সব নতুন করে শুরু করব।’ আমার স্ত্রী আস্থাভরা কণ্ঠে শুধু বলেছিল, ‘ঠিক আছে।’ ওটা ছিল ১৯৮১ সাল। ওই বছরের এপ্রিলে আ ওয়াইল্ড শিপ চেজ উপন্যাসটা লিখে শেষ করি। জানতাম, আমার জন্য এটা ‘করো বা মরো’ অবস্থা। তাই নিজের সবটুকু ঢেলে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করি। আমার লেখা উন্নত আর গভীর হতে শুরু করে, গল্পগুলো প্রাণবন্ত হতে শুরু করে। একেকটা লেখা শেষ হওয়ার পর যে রোমাঞ্চ বোধ করতাম, এমনটা আগে কখনো পাইনি। যেন শরীরের এমন সব শিরা দিয়ে রক্ত বয়ে যাচ্ছে, যা এত দিন আমার জানাই ছিল না।

এখন বুঝতে পারি, তখন যদি সবার কথায় প্রভাবিত হয়ে নিজের তাড়নাকে অগ্রাহ্য করতাম, সহজ পথ ভেবে ব্যবসা নিয়ে থাকতাম, আর পার্টটাইম লেখালেখি করতাম, তাহলে হয়তো পিনবল, ১৯৭৩-এর পরই আমার লেখকজীবনের অকালমৃত্যু হতো।

(ইংরেজি থেকে অনুদিত)