খেলা শেখান ঠিক আছে, রোবট বানিয়ে ফেলবেন না

গত ৪ মার্চ মারা গেছেন সাবেক অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার রডনি মার্শ। ৯৬ টেস্টে ৩৫৫টি ডিসমিসালের জন্য তাঁকে বলা হয় সর্বকালের অন্যতম সেরা উইকেটকিপার। ২০১৫ সালে লর্ডসে ‘এমসিসি স্পিরিট অব ক্রিকেট কাউড্রে লেকচার’-এ অতিথি ছিলেন তিনি। ব্যাট-বলের খেলা ছাপিয়ে তাঁর কণ্ঠে উঠে এসেছিল ক্রিকেটীয় চেতনার কথা।

ছবি: সংগৃহীত

আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন টেলিভিশন ছিল না। টেস্ট ম্যাচ শোনার জন্য আমাদের রেডিও কিংবা ওয়্যারলেসের ওপর নির্ভর করতে হতো। এক দিনের ক্রিকেট ছিল না। বাবা-মায়ের ঘরে বসে আমরা রেডিওতে ইংল্যান্ড থেকে সম্প্রচারিত টেস্ট ম্যাচের হাইলাইটস শুনতাম। সেই সব দিনগুলোই আমার ভেতর টেস্ট ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন জাগিয়েছিল।

আম্পায়ারদের টেলিভিশনে ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ ধরা পড়ার ভয় ছিল না। তাঁর কোনো সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ খেলোয়াড়দের ছিল না। পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ ছাড়াও খেলা ঠিকই হয়ে যেত। তবে হ্যাঁ, সে সময় বিচিত্র সব চরিত্র ছিল। মাঠের রঙ্গরসিকতাগুলোও ছিল খেলার অংশ।
অনেক কিছু বদলেছে। কিন্তু যেটা এখনো একই রকম গুরুত্বপূর্ণ আছে তা হলো, খেলাটার প্রতি, আম্পায়ারের প্রতি, বিপক্ষ দলের প্রতি, নিজের দলের সঙ্গীদের প্রতি ক্রিকেটারদের শ্রদ্ধা। অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও ইংল্যান্ড—তিনটি দেশের জাতীয় পর্যায়ের একাডেমির সঙ্গেই কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। শিক্ষানবিশ ক্রিকেটারদের প্রতি আমার এই একটা বক্তব্য খুব পরিষ্কার—শ্রদ্ধাটা থাকতেই হবে।

প্রতিযোগিতার আঁচে খেলোয়াড়েরা ভেতরে-ভেতরে কেমন টগবগ করতে থাকে, সেটা আমি বুঝি। কিন্তু আমি বুঝি না, ব্যক্তিগত আক্রমণ কীভাবে খেলাটাকে আরও রোমাঞ্চকর করে? ক্রিকেটে এটা কখনোই থাকা উচিত না। আমার প্রচণ্ড রাগ হয়, যখন শুনি ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে প্রচলিত স্লেজিংয়ের গল্পগুলোর মধ্যে একটির সঙ্গে আমার নাম জড়ানো হয়। একবার কোনো এক টেস্ট ম্যাচে আমি নাকি ইয়ান বোথামকে বলেছিলাম, ‘তোমার স্ত্রী আর আমার সন্তানেরা কেমন আছে?’ জবাবে ইয়ানও নাকি বলেছিল, ‘স্ত্রী ভালো আছে। কিন্তু ছেলেমেয়েগুলো হয়েছে বোকার হদ্দ।’ হলফ করে বলতে পারি, এমন কথা আমি কক্ষনো বলিনি। খেলাটার প্রতি আমার প্রচণ্ড শ্রদ্ধা আছে।
আমি বরং এখনো ওল্ড ট্রাফোর্ডে এক টেস্ট ম্যাচে ডেরেক র্যানডালকে একটা কথা বলেছিলাম বলে অনুতাপ বোধ করি। আমরা পুরো এক দিনেও তাকে আউট করতে পারিনি। পরদিন সকালে সে তার স্বভাবসুলভ অস্থির ভঙ্গিতে মাঠে নামল। স্টাম্পের পেছনে আমাকে দেখেই বলল, ‘শুভ সকাল রডনি।’ স্বাভাবিকভাবেই, আমি জবাব দিইনি। কেননা আমাদের ১১ জনের বিপক্ষে ওরা দুজন তখন মাঠে। আমি চাইনি ও মাঠে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করুক। কিন্তু সে বারবার আমার দিকে তাকিয়ে সকালের শুভকামনা জাতীয় কথা বলেই যাচ্ছিল। ধৈর্য ভঙ্গের প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত ওরই জয় হলো। আমি রেগে গিয়ে বলেছিলাম, ‘আমরা এখানে খেলতে এসেছি। পার্টি করতে আসিনি।’
ইয়ান চ্যাপেলকে সেই সব ক্রিকেটারদের মধ্যে বিবেচনা করা হয়, যারা ক্রিকেটীয় চেতনার খুব একটা তোয়াক্কা করত না। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, ইয়ান চ্যাপেল তার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে খেলত, কিছুতেই আপস করতে চাইত না, কিন্তু আমি কখনোই তাকে আম্পায়ার বা বিপক্ষ দলের কোনো খেলোয়াড়কে কটূক্তি করতে শুনিনি। মাঠে নিজ দলের কোনো খেলোয়াড়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফেললেও ইয়ান সেটা মাঠেই মিটিয়ে ফেলতে চেষ্টা করত। সে মনে করত এটা তার দায়িত্ব। ‘স্পিরিট অব ক্রিকেট’ একেই বলে।

১৯৭৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এক ম্যাচে রডনি মার্শের এই ক্যাচটিকে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্যাচ বলা হয়
ছবি: সংগৃহীত

মাঠে একে অপরকে অবিশ্বাস করার প্রবণতা বেড়ে গেছে সম্ভবত টেলিভিশনে খেলা সম্প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে। ধারাভাষ্যকারেরা আমাদের প্রভাবিত করেন। কিংবা একজন খেলোয়াড় যখন ড্রেসিংরুমে ফিরে গিয়ে টিভি রিপ্লেতে দেখেন যে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, তখনই তাঁর ভেতর থেকে শ্রদ্ধা ব্যাপারটা ‘নেই’ হয়ে যায়। একজন খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে আমার পরামর্শ, আম্পায়াররা যতটা ভুল করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ভুল করেন খেলোয়াড়েরা। তাই খেলার মাঠে এসব মেনে নেওয়াই উচিত।

যা আমাকে সত্যিই দুর্ভাবনায় ফেলে দেয়, তা হলো ক্রিকেটের পরিচালকেরা ক্রিকেটীয় চরিত্রগুলোকে মাঠের বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিটি খেলোয়াড় যেন একে অপরের ক্লোন। তাঁরা রোবটের মতো মাঠে নামেন, তাঁদের মুখে হাসি নেই, এমনকি ক্রোধও নেই। প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে একজন ক্রিকেটার মাঠে খেলছেন, এর চেয়ে উপভোগ্য আর কী হতে পারে! ক্রিকেট মূলত একটা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, ক্রিকেটাররা যার সঞ্চালক। তাঁদের খেলা শেখান, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তাঁদের রোবট বানিয়ে ফেলবেন না। তাঁদের দারুণ সব দক্ষতা, আবেগ আর বিচার-বুদ্ধিকে মাঠে কাজে লাগাতে দিন।
এ প্রসঙ্গে একটা দারুণ উদাহরণ আমার মনে পড়ছে। সর্বশেষ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড ওভালে হাজারো দর্শকের সামনে কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান আর অস্ট্রেলিয়া। পাকিস্তানকে আমরা ২১৭ রানে অলআউট করলাম। তখন আমরা জয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, অথচ মনে হলো দর্শকেরা গ্যালারিতে বসে বসে হাই তুলছেন। এমন সময় মাঠে এলেন বাঁহাতি ফাস্ট বোলার রিয়াজ! হঠাৎ করেই মনে হলো পাকিস্তান রুখে দাঁড়াল, পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করল। একমাত্র কারণ, এই তরুণ বোলার হঠাৎ জেতার জন্য খ্যাপাটে হয়ে উঠেছিলেন। অসাধারণ গতি আর বাউন্স দিয়ে তিনি অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপ্টেনের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। ক্রিজে অভিজ্ঞ শেন ওয়াটসন আর গ্লেন ম্যাক্সওয়েল তখন অস্বস্তি বোধ করছিলেন।
হঠাৎ করেই মনে হলো গ্যালারিতে প্রাণ ফিরে এল! মাঠে যা-ই হোক না কেন, সেটাই খেলায় প্রাণ এনেছিল। শেষ পর্যন্ত কী হলো? একটা নিষ্প্রাণ প্রতিযোগিতাকে জমজমাট করে তোলার ‘অপরাধে’ ম্যাচ শেষে রিয়াজ আর ওয়াটসনকে জরিমানা গুনতে হলো। অথচ আমার মতে, তাঁদের বোনাস দেওয়া উচিত ছিল!
‘স্পিরিট অব ক্রিকেট’ আমি বুঝি, কিন্তু ক্রিকেটের অন্য অনেক নিয়মকানুনই আমার ঠিক মাথায় ঢোকে না।

(ইংরেজি থেকে অনুদিত)