ত্রিকোণমিতি শেখার সময় sine, cosine, tan—এসব অনুপাতের খটমটে নাম মনে রাখতে সমস্যা হয়। মনে রাখার সুবিধার্থে অনেকে ‘সাগরে লবণ আছে—কবরে ভূত আছে—ট্যারা লম্বা ভূত’ এ রকম ছড়া মুখস্থ করে। কিন্তু ত্রিকোণমিতির ইতিহাস নিয়ে খানিকটা আলোচনা করলে, মুখস্থ না করেও ধারণাগুলো মনে রাখা যায়।
ত্রিকোণমিতির উদ্ভব গ্রিসে হলেও এর বিকাশ প্রাচীন ভারতে। সংস্কৃত জ্যা (উচ্চারণ জিভাহ) শব্দ থেকে ইংরেজি Sine বা সাইন শব্দটি এসেছে। জ্যা শব্দের আভিধানিক অর্থ ধনুকের ছিলা (সুতা) (চিত্র: ১ দ্রষ্টব্য)।
আব্বাসীয় আমলে আরবিতে আক্ষরিক অনুবাদের সময় জ্যাকে লেখা হয়েছিল জিবা, সংক্ষেপে jb (جب)। আরবিতে জেব (جيب) শব্দের অর্থ ‘বুক’ বা পকেট। এভাবে ধনুকের ছিলা আরবিতে এসে হয়ে গেল বুকপকেট। দ্বাদশ শতকে আরবি গ্রন্থগুলো থেকে লাতিন ভাষায় অনুবাদ করার সময় ইতালীয় লেখক ক্রেমোনার জেরার্ড জেব (جيب)–এর অনুবাদ করেছিলেন sinus, যার অর্থ বাক বা ভাঁজ। জেরার্ডের আগেও এই পরিভাষা ব্যবহারের প্রমাণ রয়েছে। ল্যাটিন sinus থেকে ইংরেজিতে sine শব্দটা চালু হয়েছে ১৫৯০-এর দশকে। Cosine বা সাইনের সহফাংশনকে cos লেখা হয়। আর tan এসেছে tangent বা স্পর্শক থেকে। চিত্র: ২–এ জ্যা থেকে সাইনের বিবর্তন সংক্ষেপে দেখানো হয়েছে।
এবার দেখা যাক, ধনুক ও স্পর্শকের সঙ্গে sine, cos, tan–এর সম্পর্ক কী। চিত্র: ৩ এবং চিত্র: ৪–এ O কেন্দ্রবিশিষ্ট একটি বৃত্তে AB একটি জ্যা।
বৃত্তের ব্যাসার্ধ এক একক। তাই ব্যাসার্ধ OB = 1। OC, AB–এর ওপর লম্ব। তাই AC = BC = x। চিত্র: ৪–এ B বিন্দুতে অঙ্কিত স্পর্শককে OC রেখার বর্ধিতাংশ C’ বিন্দুতে ছেদ করে। BC’= y হবে B বিন্দুতে অঙ্কিত স্পর্শকের দৈর্ঘ্য।
চিত্র: ৩–এ, আমরা যদি AB জ্যার দৈর্ঘ্য নির্ণয় করতে চাই, তাহলে BC–এর দৈর্ঘ্য জানাই যথেষ্ট। কারণ, BC হলো AB–এর অর্ধেক। ∠BOC = θ হলো AB জ্যা দ্বারা O কেন্দ্রে উৎপন্ন কেন্দ্রস্থ ∠AOB–এর অর্ধেক। ধরা যাক, আমরা θ–এর মান জানি। এবারে আমরা BC–এর দৈর্ঘ্য নির্ণয় করতে চাই। যদি আমরা BC/OB অনুপাতের মান জানি, তাহলে খুব সহজেই BC–এর দৈর্ঘ্য নির্ণয় করতে পারব।
একটুখানি জ্যামিতি ব্যবহার করে দেখানো যায়, θ–এর মান অপরিবর্তিত থাকলে, যেকোনো বৃত্তের জন্য BC/OB অনুপাতটির মান ধ্রুব থাকবে। এই ধ্রুব অনুপাতই হলো θ কোণের সাইন বা sinθ। এভাবেই প্রতিটি কোণের জন্য sinθ–এর মান বের করা গেলে, পৃথিবীর যেকোনো বৃত্তের জন্য BC–এর দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা যাবে। শুধু BC/OB নয়, OC/OB অনুপাতটিও একটি ধ্রুব সংখ্যা। যেহেতু OC এবং BC একই সমকোণী ত্রিভুজের দুই ভুজ বা বাহু (ভূমি ও লম্ব)। তাই ওই অনুপাতকে বলা হয় θ কোণের কোসাইন বা cosθ।
চিত্র: ৪–এ, আমরা যদি B বিন্দুতে আঁকা স্পর্শক BC’–এর মান নির্ণয় করতে চাই। তাহলে শুধু BC’/OB অনুপাতের মান জানলেই চলবে। একটি নির্দিষ্ট θ কোণের জন্য এই অনুপাতও অপরিবর্তিত থাকবে। এই অনুপাতকে বলা হয় θ কোণের স্পর্শ (Tangent) বা tanθ।
প্রশ্ন আসতে পারে, এভাবে জ্যা ও স্পর্শকের দৈর্ঘ্য হিসাব করে লাভ কী? এ প্রশ্নের উত্তর দেব পরের পর্বে। আপাতত একটা সংকেত দিচ্ছি। ত্রিকোণমিতির সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সম্পর্ক বেশ গভীর। পরের পর্বে আমরা দেখব, কীভাবে মামুলি ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করে পৃথিবী থেকে চন্দ্র ও সূর্যের দূরত্বের অনুপাত হিসাব করা যায়।