ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষা: শেষ সময়ের প্রস্তুতি ও পরীক্ষার আগের দুই দিনের করণীয়

প্রিয় পরীক্ষার্থী বন্ধুরা, গত ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় যারা আশানুরূপ ফলাফল অর্জন করতে পারোনি, তারা নিশ্চয়ই হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছ। ভাবছ, তোমাদের এত দিনের চিকিৎসক হওয়ার লালিত স্বপ্ন এই বুঝি শেষ হলো!! না, আমাদের সামনে রয়েছে ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষা (ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি-বিডিএস)। ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমেও তোমরা চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারো।

আগামী ৮ মার্চ ২০২৪ তারিখে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের সরকারি ডেন্টাল কলেজে ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জন (বিডিএস) কোর্সে প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এবার মেডিকেলের চেয়ে আসনপ্রতি বেশি আবেদন পড়েছে ডেন্টালে। প্রতিটি আসনের বিপরীতে ৯৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে। সুতরাং বুঝতেই পারছ, কতটা কঠিন হতে যাচ্ছে পরীক্ষাটি।

এবার ১টি পূর্ণাঙ্গ ডেন্টাল কলেজ ও ৮টি মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট মিলে আসন রয়েছে ৫৪৫টি। এর মধ্যে ৫৩০টি মেধার ভিত্তিতে এবং বাকি ১৫টি বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত।

পরীক্ষার মানবণ্টন

শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক পরীক্ষার মানবণ্টন। ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার মানবণ্টন ও এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার মানবণ্টন একই। ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার মোট নম্বর ৩০০। এর মধ্যে ২০০ নম্বর থাকে এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলের ওপর। আর এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত নম্বর ১০০। এর মধ্যে জীববিজ্ঞান ৩০, পদার্থবিজ্ঞান ২০, রসায়ন ২৫, ইংরেজি ১৫ এবং সাধারণ জ্ঞান (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস) বিষয়ে ১০ নম্বরের প্রশ্ন থাকে। ১০০টি প্রশ্নের জন্য সময় থাকবে এক ঘণ্টা। লিখিত পরীক্ষায় প্রতিটি ভুল উত্তর প্রদানের জন্য ০.২৫ নম্বর কাটা যাবে। লিখিত পরীক্ষায় ৪০ নম্বরের কম নম্বরপ্রাপ্ত পরীক্ষার্থীরা অকৃতকার্য বলে গণ্য হবে।

কেমন হবে ডেন্টালে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র

তোমরা জেনে খুশি হবে যে ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ধরন আর এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ধরন একই রকম। সুতরাং তোমাদের প্রস্তুতিও হবে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির মতো।

শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি

তোমাদের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি যতটা সম্ভব বেগবান করা উচিত। কারণ, সব ভালো তার, শেষ ভালো যার! সব কটি বিষয়কে সমান গুরুত্ব দিয়ে রিভিশন চালিয়ে যাওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। যারা ভালো রিভিশন দেয়, পরীক্ষায় তারাই সঠিকভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। মনে রাখতে হবে যে ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায় অনেক জটিল বা প্যাঁচানো বা দেখে অবাক হওয়ার মতো প্রশ্ন বা বিক্রিয়া খুব একটা থাকে না। ভালো প্রস্তুতি থাকলে খুব সহজেই প্রশ্নগুলোর উত্তর করা যায়।

পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান

পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান থেকে ৭৫ নম্বরের প্রশ্ন হয়ে থাকে। তাই এসব বিষয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার আর বেশি সময় নেই। আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। তাই নতুন করে কোনো কিছু না পড়ে, এত দিন যা যা পড়েছ, সেগুলোই বারবার রিভিশন দিতে হবে, চর্চা করতে হবে। বিশেষ করে মেডিকেল ও ডেন্টালের বিগত ১০ বছরের প্রশ্নোত্তরগুলো দেখতে হবে। প্রশ্নগুলো ভালোভাবে পড়ে, বুঝে তারপর সমাধান করতে হবে। পরীক্ষায় অনেক সময় বিগত বছরের প্রশ্ন হুবহু তুলে দেওয়া হয়।

ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন বুঝে সমাধান করতে হবে। যেসব বিষয় থেকে বিগত বছরগুলোয় নিয়মিত প্রশ্ন হয়েছে, সেই সব বিষয় বারবার রিভিশন দিতে হবে। টেক্সটবুকের অনুশীলনীর শেষে দেওয়া বহুনির্বাচনি প্রশ্ন অবশ্যই সমাধান করতে হবে। বেশি বেশি এমসিকিউ সমাধান করতে হবে। তুমি যত বেশি প্রশ্নের সমাধান করবে, তোমার পরীক্ষা তত ভালো হবে।

প্রশ্ন সমাধানের জন্য পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি তোমাদের সহায়ক বইয়ে দেওয়া এমসিকিউ সমাধান করতে পারো। তবে মাথায় রাখতে হবে যে পাঠ্যবইয়ের বিকল্প নেই। পাঠ্যবইয়ে দাগানো অংশগুলো বারবার পড়তে হবে। রসায়নের জন্য জৈব যৌগের বিক্রিয়াগুলোর প্রভাবক, বিক্রিয়ক আর উৎপাদগুলো মনে রাখতে হবে। ভর্তি পরীক্ষায় রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান থেকে খুব বেশি গাণিতিক সমস্যা আসে না। যেগুলো আসে, সেগুলো সহজেই করে ফেলতে পারবে। সুতরাং গাণিতিক সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।
জীববিজ্ঞান থেকে ৩০ নম্বরের প্রশ্ন হয়ে থাকে। ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায় জীববিজ্ঞান সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু এ বিষয়ের প্রশ্নের উত্তরগুলো কাছাকাছি হয়ে থাকে তাই ভুল হওয়ার আশঙ্কা অনেক। সত্য-মিথ্যা ধরনের প্রশ্ন থাকে, এগুলো ভালো করে বুঝে উত্তর করতে হবে। প্রশ্ন ভালো করে পড়তে হবে, কারণ প্রশ্নের শেষে লেজ লাগানো থাকে।

ফলে অনেক সময় সহজ প্রশ্নেরও উত্তর ভুল হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে যে সহজ প্রশ্ন মিস তো চান্স মিস। ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে জীববিজ্ঞান বুঝে পড়ার সঙ্গে মুখস্থ করাটাও জরুরি। তবে পরীক্ষার আগমুহূর্তে নতুন কিছু না পড়াই ভালো। আগের পড়াগুলোই রিভিশন করবে, প্রশ্ন সমাধান করবে, বিগত বছরের প্রশ্নগুলো দেখবে।

ইংরেজি

ইংরেজি থেকে ১৫ নম্বরের প্রশ্ন হয়ে থাকে। ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি থেকে তুলনামূলক সহজ প্রশ্ন হয়ে থাকে। তাই ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা ইংরেজির ওপর গুরুত্ব কম দিই। কিন্তু এই ইংরেজিই অন্যদের সঙ্গে তোমার পার্থক্য গড়ে দেবে এবং নিশ্চিত করবে যে তুমি কোথায় চান্স পাবে। ইংরেজিতে অসংখ্য বিষয়বস্তু রয়েছে। যেকোনো বিষয় থেকেই প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু বিগত বছরের প্রশ্নগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় থেকে প্রায় প্রতিবছরই প্রশ্ন আসে। এসব বিষয় সবার আগে শেষ করবে। এগুলো হলো—
Synonyms and Antonyms, Parts of speech, Appropriate preposition, Tense, Right form of verb, Subject verb agreement, Sentence correction, Phrases and clauses, Spelling, same word used as different parts of speech.

সাধারণ জ্ঞান

অনেকেই সাধারণ জ্ঞান বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না। এটা করা যাবে না। সাধারণ জ্ঞান থেকে ১০ নম্বরের প্রশ্ন হয়ে থাকে। ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায় একটা নম্বরেরও গুরুত্ব অনেক। ০.২৫ নম্বরের জন্যও অনেক সময় সিরিয়াল পিছিয়ে যায়। অনেক সময় স্বপ্নভঙ্গ হয়। সাধারণ জ্ঞানে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি থেকে প্রশ্ন না আসার সম্ভাবনাই বেশি। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ, সাম্প্রতিক বিষয়াবলি ইত্যাদি থেকে প্রশ্ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এসব বিষয় থেকে আসা বিগত ১০ বছরের মেডিকেল, ডেন্টাল, ঢাবি ও বিসিএসের প্রশ্নগুলো ভালো করে পড়তে হবে।

পরীক্ষার আগের দিন করণীয়

পরীক্ষার ঠিক আগের দিন বেশি পড়াশোনা না করাই ভালো। যথাসম্ভব মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। মন চাইলে বইগুলোয় হালকা চোখ বুলাতে পারো।

পরীক্ষার আগের রাতে করণীয়

পরীক্ষার আগের রাতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে হবে। যেমন প্রবেশপত্র, রেজিস্ট্রেশন কার্ড, কলম, পেনসিলসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু ফাইলের মধ্যে নিয়ে রাখো। রাতে খুব বেশি পড়াশোনা করার দরকার নেই। ভালো লাগলে বইয়ের পাতা উলটেপালটে দেখতে পারো। পরিবার–পরিজনদের কাছ থেকে দোয়া চাইতে পারো এবং অবশ্যই রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বে।

পরীক্ষার দিন সকালে করণীয়

সকালে উঠে যার যার প্রার্থনা করে নিয়ো। মাথায় রেখো যে ভর্তি পরীক্ষায় ভাগ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার পরিশ্রমের পাশাপাশি। সকালে ভারী নাশতা করার দরকার নেই। হালকা নাশতা সেরে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় চোখ বুলিয়ে নিতে পারো। এরপর পরিপাটি হয়ে আরামদায়ক পোশাক পরে প্রস্তুত হয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে পরীক্ষার হলের দিকে রওনা দেবে। কিছুটা সময় হাতে রেখে পরীক্ষার হলে আগে পৌঁছানো বুদ্ধিমানের কাজ। চেষ্টা করবে এক ঘণ্টা আগে পরীক্ষার হলে পৌঁছানোর। দূরত্ব ও যানজটের বিষয় মাথায় রেখে রওনা দেবে। তারপর পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রবেশ করে নিজের আসন ঠিকঠাক আছে কি না, তা ভালো করে যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। কোনো সমস্যা হলে দায়িত্বরত শিক্ষককে জানাতে হবে। প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পর প্রশ্ন ঠিক আছে কি না, তা ভালোভাবে দেখে নেবে। উত্তরপত্র হাতে পাওয়ার পর মাথা ঠান্ডা রেখে উত্তরপত্রের বৃত্ত ভরাট করবে। রোল নম্বর ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে ভরাট করতে হবে। প্রশ্ন যেমনই হোক, মাথা ঠান্ডা রাখা জরুরি। প্রথমে যেগুলোর উত্তর শতভাগ নিশ্চিত, সেগুলো আগে বৃত্ত ভরাট করে ফেলো। তারপর যেগুলো সঠিক হওয়ার সম্ভবনা বেশি, সেগুলো ভরাট করো। যেসব প্রশ্ন একেবারে ধারণার বাইরে, সেগুলো দাগানো দরকার নেই। আর হ্যাঁ, পরীক্ষার হলে মাথা গরম করা যাবে না।

মনে রেখো

যদি এই ৬০ মিনিট মাথা ঠান্ডা রেখে প্রশ্নের উত্তর করে আসতে পারো, তাহলে সাদা অ্যাপ্রনটা তোমারই হবে। চিকিৎসক হওয়ার লালিত স্বপ্ন পূরণ হবে। দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। তোমার সঙ্গে তোমার সৃষ্টিকর্তা আছেন, আছে তোমার অদম্য সাহস, ইচ্ছা আর পরিশ্রম যা তোমাকে নিয়ে যাবে তোমার লালিত স্বপ্নের ঠিকানায়। সব ভবিষ্যৎ চিকিৎসকের জন্য শুভকামনা রইল।

মো: তারিকুল ইসলাম তারিক, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট, জাতীয় মেধায় ১৩৫তম, ২০১৯-২০ সেশন