করোনাভাইরাস কেন গবেষণাগারে বানানো নয়
এমন একটি রটনা চলছে যে করোনাভাইরাসটি যাকে এখন SARS-CoV-2 বলা হচ্ছে, সেটি চীন দেশের জৈবিক মারণাস্ত্রগারে তৈরি হয়েছে। গুজবটি আরও প্রাণ পেয়েছে এই কারণে যে চীনের উহান শহরে একটি ভাইরাস নিয়ে গবেষণাগার আছে। কিন্তু বর্তমানের বিভিন্ন গবেষণা বলছে, এই ভাইরাস প্রকৃতি থেকে এসেছে, সম্ভবত কোনো প্রাণী থেকে। এর উৎস হতে পারে বাদুড় বা বনরুইয়ে (প্যাংগোলিন) মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী। যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্রিপস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের যৌথ একটি গবেষণায় এটি প্রমাণ হয়েছে। এর আগে চীনা বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের পূর্ণ জিনোম তথ্য প্রকাশ করেছিলেন (Ren et al.2020, Identification of a Novel Coronavirus Casuing Severe Pneumonia in Humans, Chinese Medical Journal), যা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন।
সার্স-কোভ-২ অন্য ভাইরাসের মতোই খুবই ক্ষুদ্র এবং এটি সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়বে না। ইলেকট্রন স্ক্যানিং অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ধারণ করা এর ছবিটি নিচে দেওয়া হলো। এদের ব্যাস ৫০ ন্যানোমিটারের মতো।
প্রতিটি ভাইরাসের ভেতরে ডিএনএ ও আরএনএর মতো বংশীয় নিউক্লিওটাইড থাকে, যা কিনা একটি প্রোটিনের আবরণে মোড়া। এর মধ্যে কিছু প্রোটিন গজালের মতো ভাইরাসের দেহ থেকে বের হয়ে থাকে। করোনাভাইরাসের ভেতরে রয়েছে একটা আরএনএ ফিতা। আর বাইরে S-প্রোটিন নামে একটি গজাল বা স্পাইক রয়েছে। নিচের ছবিটিতে S-প্রোটিনটি খেয়াল করুন। গজালের মতো এই S-প্রোটিন মানবদেহের কোষের বাইরে ACE 2 নামে একটি গ্রাহক প্রোটিনের (রিসেপটর) সঙ্গে যুক্ত হয়। এই গ্রাহক প্রোটিন আমাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত।
ভাইরাসের গজালের মতো S-প্রোটিনটির মানবকোষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দক্ষতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে তার সাফল্য। বিজ্ঞানীরা এই প্রোটিনের জিনোম কী দিয়ে তৈরি, তা এরই মধ্যে বের করেছেন। এই S-গজাল বা স্পাইক প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক আণবিক রূপটি বিজ্ঞানীরা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। নিচে সেই ছবিটি দেওয়া হলো— (Daniel Wrapp, University of Texas at Austin, Science, 2020).
বিভিন্ন ভাইরাস বিভিন্ন ধরনের spike প্রোটিন দিয়ে মানবকোষে আবদ্ধ হয়। নিচের ছবিতে লাল গজালগুলো হলো S spike প্রোটিন ও রেঞ্চ দিয়ে ACE 2 গ্রাহককে বোঝানো হয়েছে। আগেই বলেছি ACE 2-এর সঙ্গে S কতখানি সফলভাবে যুক্ত হতে পারবে, তার ওপর এই ভাইরাসের সফলতা নির্ভর করছে।
এ ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে S গজালের যে Receptor Binding Domain (RBD)-এর অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো আছে তারা সফল। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্রিপ্স গবেষণাগারের একটি কাজ বলছে, এই RBD-এর বড়শি ACE 2-তে আটকানোর জন্য এতটাই সফল যে (পূর্বতন SARS ভাইরাস থেকে ১০ গুণ বেশি) সেটার প্রকৃতিতে অসংখ্য পরিব্যপ্তির (mutation) মধ্যেই সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এ ছাড়া এই গবেষকেরা আরও বলছেন, যদি এটাকে কৃত্রিম উপায়ে ল্যাবেই তৈরি করা হতো, তাহলে তারা এমন একটা ভাইরাসকে কাজ করার জন্য বেছে নিত, যাকে কিনা তারা আগে থেকেই চিনত, যেটা কিনা মানুষকে রোগাক্রান্ত করে। যদি তারা SARS-Cov-কে বেছে নিত তাদের জৈবিক অস্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, তাহলে দেখা যাচ্ছে কম্পিউটার সিমুলেশন SARS-Cov-2-এর গজাল S প্রোটিনের গঠন সেখান থেকে তারা পাচ্ছেন না, কম্পিউটার তাদের অন্য ধরনের গজাল প্রোটিনের গঠন দেখাচ্ছে, যা কিনা SARS-Cov-এর S গজাল থেকে কম দক্ষ। বরং SARS-Cov-2-এর আণবিক গঠন বাদুড় ও বনরুইয়ের মধ্যে পাওয়া যায় এমন করোনাভাইরাসের সঙ্গে খুব মিল, যাতে মনে হয় এটি খুব অধুনাকালে চীনে প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে।
এবার আসি এই নতুন ভাইরাসের আর একটি দক্ষ বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে। S গজালকে আবার দু ভাগে ভাগ করা যায়—S1 ও S2। নিচে অন্য একধরনের করোনা ভাইরাস থেকে এই দুটি অংশকে দেখানো হচ্ছে। S1 এবং S2-এর মধ্যের অংশকে বলা হয়ে cleavage site বা ভাগ করে দেওয়ার স্থান, আমরা একে খণ্ডন অংশ বলে অভিহিত করব। এই কর্তন অংশে ফুরিন (Furin) নামে প্রোটিন কাজ করে S গজালকে দুভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ মানবকোষে ভাইরাসটিকে প্রবেশ করতে হলে ACE 2 গ্রাহক থেকে তাকে মুক্ত হতে হবে, ফুরিন দিয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে S2 সহ ভাইরাসের দেহটি কোষের দেহের সঙ্গে বিলীন হয়ে যেতে পারে ভেতরের RNA ফিতাটিকে অক্ষয় রেখে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ঠিক এই ধরনের খণ্ডন অংশ অন্য ধরনের করোনাভাইরাসে পাওয়া যায়নি এবং এটিকেও গবেষণাগারে সৃষ্টি করা কঠিন।
দীপেন ভট্টাচার্য: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শিক্ষাবিদ ও অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট