কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছিলেন। আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান শিক্ষকদের একটি অংশও। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। অভ্যুত্থানের আগে-পরে কমবেশি প্রায় তিন মাস অচলাবস্থায় থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সচল করা ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে শিক্ষার কাজ নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, সেটির প্রতিফলন শিক্ষা খাতে এখনো সেভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। মূলত রুটিন কাজের মধ্যেই শিক্ষার কাজ-কর্ম চলছে। অনেক ক্ষেত্রে দাবির মুখে এইচএসসির কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষা বাতিলের মতো তাৎক্ষণিক কিছু সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা রয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন হলেও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো কমিশন হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে শিক্ষার কাজ নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, সেটির প্রতিফলন শিক্ষা খাতে এখনো সেভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে সামগ্রিকভাবে শিক্ষায় সমস্যার কথা বলা হয়েছিল; কিন্তু তার বিপরীতে বড় কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না; বরং শিক্ষা এখনো সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই বলে তাঁরা মনে করছেন। অথচ এ বিষয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর ১৭ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। তাঁকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হয়। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। ১০ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় অধ্যাপক এম আমিনুল ইসলামকে বিশেষ সহকারী নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তাঁর কাজ শিক্ষা উপদেষ্টাকে সহযোগিতা করা।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার। অবশ্য স্বায়ত্তশাসিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে আগের পথেই হেঁটেছে সরকার।
রুটিন কাজে সীমাবদ্ধ
বর্তমানে দেশে ৫৫টি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় চারটি। বাকি ৫১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অচলাবস্থা কাটতে শুরু করেছে। শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আবাসিক হলগুলোতে আসন বরাদ্দে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে আসন দেওয়া শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার। অবশ্য স্বায়ত্তশাসিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে আগের পথেই হেঁটেছে সরকার। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের নিয়ম হলো সিনেটে ভোটের মাধ্যমে তিনজনের একটি প্যানেল ঠিক করা হবে। তাঁদের মধ্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি একজনকে উপাচার্য নিয়োগ করবেন; কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও সেটি হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, বিশেষ পরিস্থিতি ও সময়ের অভাবে এটা করা সম্ভব হয়নি।
এরই মধ্যে এখন ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজ নিয়ে নতুন সংকটের মুখে পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষার্থীরা এই সাত কলেজের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আন্দোলন করছেন। অন্যদিকে তিতুমীর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আন্দোলন করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), এনসিটিবির শীর্ষ পদেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ৯ শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে অধ্যাপক করা হয়েছে।
১৮ আগস্ট দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ইঙ্গিত দেন, আলোচনা-সমালোচনার মুখে থাকা নতুন শিক্ষাক্রম থাকছে না। সেদিন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাই যত দূর পারবেন, তাঁরা আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাবেন। এরপর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা নতুন শিক্ষাক্রম কার্যত বাদ দিয়ে অনেকটা পরীক্ষানির্ভর পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই দেওয়ার কাজ শুরু করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে বিনা মূল্যের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ সমন্বয়ের লক্ষ্যে গঠিত সমন্বয় কমিটি গঠনের পর সেটি আবার বাতিল করায় সিদ্ধান্তটি নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা হয়। অনেকেই বলছেন, এটা সরকারের দুর্বলতার প্রকাশ। এ রকম পরিস্থিতিতে জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ্যবই পাবে শিক্ষার্থীরা। তবে এবার নির্ধারিত সময়ে সব শিক্ষার্থী নতুন সব বই পাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। কারণ কাজগুলোর গতি এখনো কম।
শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনার মধ্যে ২০ আগস্ট প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ করেন বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। ওই দিন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করে সরকার। এরপর গত ১৫ অক্টোবর ভিন্ন উপায়ে ফল প্রকাশ করা হয়; কিন্তু তার বিরুদ্ধেও আবার আন্দোলনে নামেন একদল শিক্ষার্থী। বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের সামনে বিক্ষোভ-ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন তাঁরা। একপর্যায়ে গত ২৩ অক্টোবর ‘বৈষম্যহীন’ ফলের দাবিতে সচিবালয়ে ঢুকে বিক্ষোভ করেন অনেক শিক্ষার্থী। অবশ্য সেই দাবি আর মানা হয়নি।
এরই মধ্যে এখন ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজ নিয়ে নতুন সংকটের মুখে পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষার্থীরা এই সাত কলেজের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আন্দোলন করছেন। অন্যদিকে তিতুমীর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আন্দোলন করছেন। এই সাত কলেজের সমস্যা সমাধানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্যে তিতুমীর সরকারি কলেজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সম্ভাব্য যাচাইয়ে আরেকটি কমিটি করার কথা বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এগুলো হচ্ছে আন্দোলনের মুখে; কিন্তু সার্বিকভাবে সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত আশা করছে সবাই।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত তিন মাসে যে কাজের বিবরণ তৈরি করেছে তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন উপাচার্য নিয়োগের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। কলেজ অনুবিভাগের যে কাজের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে গত ২৪ আগস্ট ২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের ৭৪ কর্মকর্তাকে বিভিন্ন সরকারি কলেজে পদায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়াও এনসিটিবিকে চেয়ারম্যান, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে পরিচালক নিয়োগ, ২৩ আগস্ট অধ্যাপক পদে ৯২৭ জনকে পদোন্নতি, অনেকের শিক্ষা ছুটি অনুমোদন ইত্যাদি কাজের কথা বলা হয়েছে; কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে এখনো নিয়মিত মহাপরিচালক নিয়োগ করা যায়নি। বর্তমানে সংস্থাটির কলেজ ও প্রশাসন শাখার পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে মহাপরিচালকের কাজ করছেন।
আর্থিক সংকটের কারণে এমনিতেই বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণসুবিধার টাকা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এখন সরকার পরিবর্তনের পর অবসর–সুবিধা বোর্ড পুনর্গঠন না করায় এই সমস্যা প্রকট হয়েছে। দিন যত যাচ্ছে, শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর–সুবিধার টাকা পেতেও অপেক্ষার সঙ্গে কষ্ট ও ভোগান্তি বাড়ছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় রুটিন কাজের বাইরেও সংস্কারে কিছুটা উদ্যোগী হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার।
প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদের নেতৃত্বে শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং প্রাথমিক শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ৯ সদস্যের পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশা করছেন, এই কমিটি যে সুপারিশ দেবে, তা যদি সঠিকভাবে গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়ক হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য একটি সংস্কার কমিশন হওয়া জরুরি। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে ১১টি সংস্কার কমিশন করা হলেও শিক্ষার জন্য কমিশন না হওয়ায় শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকেই হতাশ।
শিক্ষাকে সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখতে হবে এবং সেটি বিবেচনায় নিয়ে কর্মপরিকল্পনা করে এগোতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম কথা হলো অনেক প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে এই সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। মানুষ স্বাগত জানিয়েছে। সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই। বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার হচ্ছে এবং পরিকল্পনা হচ্ছে; কিন্তু কেন যেন দিনে দিনে মনে হচ্ছে শিক্ষা অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকছে না। অথচ মানব সক্ষমতা বিনির্মাণে বড় হাতিয়ার হলো শিক্ষা। যত সংস্কার হোক না কেন দক্ষ মানবসম্পদ না হলে তা কাজে দেবে না। তাই শিক্ষাকে সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখতে হবে এবং সেটি বিবেচনায় নিয়ে কর্মপরিকল্পনা করে এগোতে হবে।