পুরোনো শিক্ষাক্রমে বই, বিষয়বস্তুতে কতটা পরিবর্তন

২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি পাঠ্যবই পাবে শিক্ষার্থীরা। তবে বইয়ের বিষয়বস্তুতে কিছু পরিবর্তন হবে।ফাইল ছবি প্রথম আলো

আগামী বছর চতুর্থ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমের পরিবর্তে ২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি পাঠ্যবই পাবে শিক্ষার্থীরা। তবে বইয়ের বিষয়বস্তুতে কিছু পরিবর্তন হবে। বিশেষ করে ইতিহাসনির্ভর বিষয়ে বেশি পরিবর্তন হচ্ছে। দু-একটি নতুন গল্পও যুক্ত হচ্ছে। আগামী বছর থেকে বইয়ের সংখ্যাও বাড়বে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সংস্থাটি বলছে, পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে ইতিমধ্যে পাঠ্যবই আছে। সেগুলোই এখন পরিমার্জন করে ছাপার উপযোগী করা হচ্ছে। এই পরিমার্জনের কাজটি করছেন ৫০ জনের বেশি বিশেষজ্ঞ।

নতুন শিক্ষাক্রমে বইয়ের সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু পুরোনো শিক্ষাক্রমে বইয়ের সংখ্যা বেশি। নতুন শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিকে একেকটি শ্রেণির জন্য ১০টি বিষয় ছিল। পুরোনো শিক্ষাক্রমে বিষয় আরও বেশি। তবে বইয়ের সংখ্যা বেশি। যেমন পুরোনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিকে বইয়ের সংখ্যা ২৩ (সব কটি সবার জন্য নয়)।

একদিকে বইয়ের সংখ্যা বেশি, অন্যদিকে বইয়ের বিষয়বস্তুতেও পরিবর্তন আসছে। তাই ইতিমধ্যে যেসব শ্রেণির বই ছাপার দরপত্র দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে আগামী বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে সব পাঠ্যবই তুলে দেওয়া বেশ চ্যালেঞ্জ হবে। যদিও এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী বছর ‘পাঠ্যবই উৎসব’ হবে না। তবে শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা আছে।

বর্তমানে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার কার্যত নতুন এই শিক্ষাক্রম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরাসরি বাদ বা বাতিল শব্দটি ব্যবহার না করে সরকার বলছে, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয়।

এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কার্যক্রমভিত্তিক শিখন শেখানো (অ্যাকটিভিটি বেজড টিচিং লার্নিং) পদ্ধতি অনুযায়ী পাঠ্যবই প্রণয়ন হয়েছে। তাই এই তিন শ্রেণির বইয়ে বড় কোনো পরিবর্তন হবে না। প্রচ্ছদ বা ভেতরের কিছু লেখায় সামান্য কিছু পরিবর্তন হবে। এ জন্য প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার বিষয়ে ইতিমধ্যে যে দরপত্র দেওয়া হয়েছে, তার আলোকেই হবে। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে পুরোনো শিক্ষাক্রমই প্রাধান্য পাবে।

বর্তমানে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার কার্যত নতুন এই শিক্ষাক্রম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরাসরি বাদ বা বাতিল শব্দটি ব্যবহার না করে সরকার বলছে, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, নানা আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২০১২ সালের পুরোনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, আগামী বছর পাঠ্যবই দেওয়া হবে। তবে ২০২৬ সাল থেকে আবারও নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে বই দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।

বর্তমানে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছর চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর মধ্য দিয়ে মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শ্রেণিতেই তা চালুর কথা ছিল; কিন্তু এখন নতুন শিক্ষাক্রম কার্যত বাতিল হয়ে গেল।

অন্যদিকে পরিমার্জনের মাধ্যমে পাঠ্যবইয়ে নতুন কিছু বিষয়ও যুক্ত হতে পারে। যেমন মাধ্যমিকে হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক উপন্যাস ১৯৭১ যুক্ত করা হচ্ছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

এনসিটিবির সূত্র জানিয়েছে, এখন পুরোনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ্যবই পরিমার্জন করে ছাপার উপযোগী করা হচ্ছে।

এই পরিমার্জনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি যুক্ত হয়েছেন। যেমন বাংলা বইয়ের পরিমার্জনের সঙ্গে যুক্ত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও বাংলা একাডেমির সদ্য নিয়োগ পাওয়া মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম ও লেখক রাখাল রাহাসহ তিনজন। বিজ্ঞানের বইয়ের পরিমার্জনের দায়িত্বে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক কামরুল হাসানসহ আরও কয়েকজন। ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের পরিমার্জনের মূল দায়িত্বে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা।

রাখাল রাহা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এ মাসের মধ্যেই পরিমার্জনের কাজটি শেষ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। আশা করছেন, তা পারবেন।

আগের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করে পাঠ্যবই ছাপিয়ে বছরের শুরুতেই দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করছি, সবার সহযোগিতায় সময়মতো মানসম্মত পাঠ্যবই দিতে পারব।
এ কে এম রিয়াজুল হাসান, চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড

ইতিহাসে কাউকে বড় নয়, কাউকে ছোটও নয় নীতি

এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন বইয়ে ইতিহাসনির্ভর অধ্যায়গুলোয় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে নীতির কথাটি এনসিটিবিকে জানিয়েছে, সেটি হলো ইতিহাসের লেখায় কাউকে বড় করে দেখানো যাবে না, আবার কাউকে ছোটও করা হবে না। এ ছাড়া ইতিহাস বিষয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও যেন না থাকে। এই নীতির আলোকে পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসনির্ভর বিষয়গুলো স্থান পাবে।

এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রীয় দর্শন ও ইতিহাস ‘যথাযথ’ আছে কি না, সেটি যাচাই করতে তাঁদের বলা হয়েছে। এ ছাড়া স্পর্শকাতর বিষয় হলে বিকল্প চিন্তা করে পরিমার্জন করতে বলা হয়েছে।

এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, নতুন ও পুরোনো শিক্ষাক্রমের বিষয়টি মাথায় রেখে গণিত বই নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবছে এনসিটিবি। এ ক্ষেত্রে ‘পরিশিষ্ট’ হিসেবে শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু বিষয় সংযোজন আকারে দেওয়া হতে পারে।

অন্যদিকে পরিমার্জনের মাধ্যমে পাঠ্যবইয়ে নতুন কিছু বিষয়ও যুক্ত হতে পারে। যেমন মাধ্যমিকে হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক উপন্যাস ১৯৭১ যুক্ত করা হচ্ছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

আগের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করে পাঠ্যবই ছাপিয়ে বছরের শুরুতেই দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করছি, সবার সহযোগিতায় সময়মতো মানসম্মত পাঠ্যবই দিতে পারব।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে এম রিয়াজুল হাসান

নবম-দশম শ্রেণির বই যেভাবে

পুরোনো শিক্ষাক্রমে নবম ও দশম শ্রেণি মিলিয়ে এসএসসি পরীক্ষা হয়। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে কেবল দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। বর্তমানে যারা নবম শ্রেণিতে পড়ছে, তারা ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। এই শিক্ষার্থীরা প্রায় ৯ মাস হতে চলল নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে বই পড়ে ফেলেছে। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে, এসব শিক্ষার্থী আগামী বছর দশম শ্রেণিতে উঠে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা বেছে নেবে। তাদের জন্যও ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের আলোকে পরিমার্জিত পাঠ্যবই দেওয়া হবে। তবে পাঠ্যবইগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি তৈরি করা হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা এক শিক্ষাবর্ষের মধ্যেই পাঠ্যসূচি শেষ করতে পারে।

আর যারা অষ্টম শ্রেণি শেষ করে আগামী বছর নবম শ্রেণিতে উঠবে, তারা পুরোনো নিয়মেই বই পাবে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে এম রিয়াজুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করে পাঠ্যবই ছাপিয়ে বছরের শুরুতেই দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করছি, সবার সহযোগিতায় সময়মতো মানসম্মত পাঠ্যবই দিতে পারব।’