শিক্ষায় চাপ নয়, দরকার অনুপ্রেরণা

ফাইল ছবি

মা–বাবা যা হতে বা করতে পারেনি, তা করাতে শিশুর প্রতি চাপ সৃষ্টি করলে হয়তো সম্ভব মা–বাবার স্বপ্নপূরণ, কিন্তু শিশুটির জন্ম হয়েছিল হয়তোবা অন্য কিছু করার জন্য, সেটা যে হলো না, তা কি কখনো আমরা ভেবে দেখেছি? যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ধরন পাল্টানোর সময় এসেছে। গোটা বিশ্বের চাহিদা এবং সমন্বয়ের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা প্রশিক্ষণের। সে ক্ষেত্রে বিশেষ করে শিশুশিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি। শিশুদের অনুকরণ ও অনুসরণের ক্ষমতা তাদের শুরু থেকেই খুব বেশি, তাই এই ধারণ ক্ষমতাকে দেরি না করে প্রথম থেকেই তাদের ইচ্ছানুযায়ী নির্দিষ্ট ফর্মে আনার জন্য চেষ্টা করা হোক ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ফর ম্যানকাইন্ড বা মানবজাতির জন্য ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ।

শিশুদের মেধাকে ছোটবেলা থেকেই আবিষ্কার করে তাদের জ্ঞানচর্চার নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি যুগোপযোগী করা দরকার। মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা দরকার এজ আর্লি এজ পসিবল (যত তাড়াতাড়ি সম্ভব)। বর্তমান বিশ্বে খেলাধুলার ক্ষেত্রে শিশুদের তৈরি করা হচ্ছে ৭ থেকে ১২ বছরের সময়ের মধ্যে, যেসব শিশু এ সময়ের মধ্যে ভালো করছে না, তারা অন্য প্রফেশন বা পেশা বেছে নিচ্ছে। জার্মানিতে প্রাথমিক পর্যায়ে চতুর্থ শ্রেণি থেকে যাচাই–বাছাই করে শিশুদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, শিশুদের চাহিদা এবং পছন্দ অনুযায়ী স্কুলে প্রশিক্ষণ দেওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যার কারণে তাদের লেখাপড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সরাসরি সরকারি–বেসরকারি চাকরি পেয়ে যাচ্ছে এবং জীবনের মূল্য খুঁজে জীবনকে মধুময় করে তুলছে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক দিক দিয়ে।

আন্দাজের ওপর লাখো লাখো শিশু শিক্ষার্থীকে একই পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ না করে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা প্রদান করা হোক নিউ ওয়ে অফ এডুকেশনের মূল লক্ষ্য।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতিতে নবম শ্রেণি থেকে ছাত্রছাত্রীদের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে তারা কী হতে চায়। এ পদ্ধতি চলে আসছে পুরোনো পদ্ধতির শিক্ষার শুরু থেকে। কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন ছাড়াই ট্রেডিশন অনুযায়ী শিক্ষা প্রশিক্ষণ চলছে যুগ যুগ ধরে। অথচ গুগলের যুগে যেখানে কলকারখানা থেকে শুরু করে মানবজাতির চাহিদা এবং শিক্ষার গতি দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে পুরোনো পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রশিক্ষণ দিলে সার্বিকভাবে শিক্ষার মান নিম্নমানের হবে/হচ্ছে বহির্বিশ্বের তুলনায়। এ কারণে লাখো লাখো শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়তে থাকছে, জীবন জয়ের লড়াই চলছে আজীবন দরিদ্রতার মধ্যে দিয়ে। কারণ, দেশের শিক্ষার মান মূল্যায়ন হচ্ছে না তুলনামূলকভাবে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের সঙ্গে।

ফাইল ছবি

পুরোনো পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রশিক্ষণ দেওয়ার ফলে শিক্ষিতের হার বাড়ছে ঠিকই কিন্তু তাদের কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না বিধায় তারা দেশের মধ্যে হতাশার মধ্যে গুদামজাত অবস্থায় বসে বসে অন্নের ধ্বংস করছে। একটি উদাহরণ দিতে চাই, আগে একটি চিঠি বাংলাদেশ থেকে সুইডেনে পাঠালে তা আসতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ লেগে যেত। পরে তার উত্তর দিতে একই সময়, সব মিলে একটি চিঠির খবর পৌঁছাতে যে সময় লাগত, এখন তা মুহূর্তের মধ্যেই পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ অতীতের প্রশিক্ষণ, ইনফরমেশন ও কমিউনিকেশন ছিল এ যুগের তুলনায় খুবই ধীরগতি। স্বাভাবিকভাবেই মানবজাতির ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, বর্তমান ইনফরমেশন ও কমিউনিকেশনের যুগে। ফলে আমাদের ধ্যানে ও জ্ঞানে দ্রুততার সমন্বয় ঘটেছে। এ অবস্থায় শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষাপদ্ধতি যদি যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে পুরোনো পদ্ধতিতে চলতে থাকে, তবে সমস্যা এবং বেকারত্বের সংখ্যা বাড়বে ছাড়া কমবে না।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সুশিক্ষার বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে মনুষ্যত্বের অবক্ষয়। এখন কীভাবে ফিরে পেতে পারি সেই সুশিক্ষা এবং মনুষ্যত্বকে। কেমন হওয়া উচিত দেশের কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা এবং কখন শুনব সেই বিজয়ের ধ্বনি। মানবজীবনে দীর্ঘমেয়াদি পরাজয় বলে কিছু নেই, তবে এর একটি সংক্ষিপ্ত সময় আছে। জয়–পরাজয় জীবন চলার চাবিকাঠি। জীবনে বেঁচে থাকতে দুটোরই দরকার রয়েছে, যেমন দরকার রয়েছে আলো এবং অন্ধকারের। অন্ধকার ছাড়া যেমন আলোর অস্তিত্ব নেই, ঠিক পরাজয় ছাড়া জয়ের অস্তিত্ব নেই।

জন্মের সূচনালগ্ন থেকে বাংলাদেশ এক স্বপ্নতাড়িত দেশ, স্বাধীন দেশ হিসেবে সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, স্বাধীনতার এত বছর পরও সে স্বপ্ন অর্জিত হয়নি।
এটা অনস্বীকার্য যে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটা দক্ষ ও সুশিক্ষিত নাগরিক সমাজ গঠন করতে হলে যে কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন আমরা তা এখনো গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। দেশের প্রতিটি উন্নয়ন-রূপকল্পের ভিত্তিমূলেই রয়েছে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের প্রতিধ্বনি। কিন্তু দক্ষ ও সুশিক্ষিত নাগরিক সমাজ গঠনের জন্য কোনো কার্যকর ও টেকসই প্রকল্প গ্রহণ করতে না পারলে দেশের উন্নয়ন-রূপকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

সব দেশের মানুষেরই প্রথম চাওয়া এখন সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা, আর শিক্ষা বলতে বোঝায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের ঘিরে আবর্তিত হয়। যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা–সম্পর্কিত সব উদ্যোগ, সব প্রক্রিয়া শ্রেণিকক্ষে সঞ্চারণ করার অদ্বিতীয় সঞ্চারক হচ্ছেন শিক্ষক, সেহেতু শ্রেণিকক্ষে যুগোপযোগী শিক্ষা সঞ্চারণ করার জন্য শিক্ষককে নিতে হয় প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন প্রস্তুতি। এসব প্রস্তুতির জন্য সহায়ক মাধ্যম হচ্ছে প্রশিক্ষণ। আমাদের শিক্ষকসমাজ কি সে মাপের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারছে? অর্থাৎ আমাদের শিক্ষকসমাজ কি প্রস্তুত?

সব শিক্ষার্থীই কোনো না কোনো গুণে সমৃদ্ধ। তা ছাড়া শিক্ষা হলো সবার জন্মগত অধিকার। কাজেই সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাই সবাইকে সুযোগ দিতেই হবে। কিন্তু শুধু সুযোগ দিলেই তো হবে না, নিশ্চিত করতে হবে তারা যেন ভালো শিক্ষা পায়। ভালো শিক্ষা যদি চাই, ভালো শিক্ষক ছাড়া তা কিছুতেই সম্ভব নয়।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাধারার একমাত্র বাহক শিক্ষকসমাজই যদি মজবুত না হয়, শিক্ষার্থী নামক বাহনের অভিযাত্রীরা কি নির্বিঘ্নে এই বৈতরণি পাড়ি দিতে পারবে? সে প্রশ্ন সব নাগরিকের, সব অভিভাবকের। আমরা জানি, শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দরকার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। শিক্ষকের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য একদিকে প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত ও স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা, অন্যদিকে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক-শিক্ষা এবং চাহিদাভিত্তিক যুগোপযোগী পৌনঃপুনিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধন করা। সমগ্র দেশের শিক্ষাচিত্রে বাস্তবে ভিন্ন চিত্র বিরাজ করলেও শিক্ষানীতিতে মানসম্মত, চাহিদাভিত্তিক, যুগোপযোগী, পৌনঃপুনিক, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পেশাগত উৎকর্ষ সাধন—এসব বিষয়ের ওপর জোর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

দেশে প্রাথমিক শিক্ষাই এখন পর্যন্ত শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি। প্রাথমিক শিক্ষাকে এখনো সর্বজনীন করা সম্ভব হয়নি। এখনো শিক্ষার প্রতিটি স্তর থেকে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী নিয়মিত ঝরে পড়ছে। এই হার কোনো কোনো স্তরে প্রায় এক–চতুর্থাংশ, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।

এখন দরকার দেশের সব কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে সব স্তরের শিক্ষকের প্রশিক্ষণ প্রদান ও গ্রহণের একটি সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করা। দরকার শিক্ষকদের পেশাগত জ্ঞান বৃদ্ধি ও যুগোপযোগীকরণে সহায়তা দান, শিক্ষকদের ব্যক্তিত্ব, উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধি এবং নেতৃত্বের গুণাবলি জাগ্রত করা, নতুন নতুন শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে দক্ষতা ও কৌশল বৃদ্ধি করা। দায়িত্ব ও কর্তব্যসচেতন থেকে কার্য সম্পাদনের জন্য শিক্ষকদের উৎসাহিত করা হবে—Value of teaching is learning from learners.

লেখক

ডিজিটালাইজেশন ও গ্লোবালাইজেশনের যুগে মডার্ন ও মানসম্মত টেকনোলজির মোকাবিলা করার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীকে সেভাবে গড়ে তোলা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীরা যে লেখাপড়া করছে না তা নয়, ভূরি ভূরি জিপিএ–৫ রয়েছে তার প্রমাণ। সমস্যা হচ্ছে, সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে। এর থেকে রেহাই পেতে হলে চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে যুগোপযোগী শিক্ষার জন্য। মানবতা ও নৈতিকতারও সমন্বয় ঘটাতে হবে। তবেই হবে আদর্শ সুশিক্ষা এবং তা হবে আর্নিং বাই লার্নিং বা শেখার দ্বারা উপার্জন।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন