বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে সমস্যা প্রক্রিয়ায় না সদিচ্ছায়
বেশ কয়েক দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগ গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। সরকারি, অর্থাৎ জনসাধারণের অর্থে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রচলিত অর্থে ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়’ বলা হয়। সে অর্থে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে জনসাধারণের যে আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহ থাকবে, গণমাধ্যম যে তাকে প্রাধান্য দেবে, এটাই কাঙ্ক্ষিত। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বচ্ছতা নিশ্চিতে গণমাধ্যমে এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশও অত্যন্ত জরুরি। সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণনিয়োগ বাতিল করা হয়েছে এবং নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে উচ্চতর আদালতে রিট দাখিল করা হয়েছে, যা আদালতের বিবেচনাধীন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রায় দুই যুগ পার করে কেবলই মনে হয় ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’। এত বছর পরও নিয়োগ নিয়ে ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি শাসকদের কণ্ঠ আমরা এখনো প্রতিধ্বনিত হতে শুনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে যে দুর্নীতি হয়, তা রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় এবং হয়তোবা সামগ্রিক বিবেচনায় সংখ্যার দিক থেকে নগণ্যও বটে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাতি এর নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে যে ‘শূন্য সহনশীলতা’ প্রত্যাশা করে, এটি তার থেকে বহু বহু যোজন দূরে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে জাতপাত নিয়ে বিতর্ক থাকলেও নিয়োগের মান নিয়ে বিতর্ক ছিল নগণ্য। আর এখন দল-মত-গোষ্ঠীর পাশাপাশি নিয়োগের মান নিয়েও অস্বস্তিকর বিতর্ক হচ্ছে ব্যাপকহারে। তাহলে প্রশ্ন জাগে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে রচিত বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ কি লঙ্ঘিত হচ্ছে? দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ (একটির সঙ্গে অন্যটির কিছু পার্থক্য রয়েছে) অনুযায়ী চলে। আলোচনার সুবিধার্থে বিষয়টি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩-এর আলোকে বিশ্লেষণ করা হলো।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় বাংলাদেশ সরকারের সংবিধান অনুযায়ী সংসদ কর্তৃক প্রণীত বিধান হলো বিশ্ববিদ্যালয় আইন। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সংসদ এ ধরনের একটি করে আইন প্রণয়ন করেছে, যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩। এই আইনের বিধান অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট ও অন্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত বিধানের নাম যথাক্রমে সংবিধি (Statutes), অধ্যাদেশ (Ordinances) ও বিধি (Regulations)। দেশের আইন অনুসারে যে কর্তৃপক্ষ যে আইন প্রণয়ন করছে, তা সংশোধনের ক্ষমতা কেবল তারই থাকে, যেমন সংসদে প্রণীত আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ পরিবর্তন করতে পারবে না। আবার সংবিধানের মৌলিক কিছু আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন যেমন সংসদও প্রণয়ন করতে পারে না, তেমনই সংসদ কর্তৃক প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কর্তৃপক্ষ প্রণয়ন করতে পারেন না। এখানে কর্তৃত্বের ক্রম হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় আইন, সংবিধি, অধ্যাদেশ ও বিধি।
সংসদ কর্তৃক প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় আইনে কিছু মৌলিক দিকনির্দেশনা দিয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সংবিধি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে এবং সংবিধিতে অনেকটা বিস্তারিতভাবে প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে (অ্যাক্টের ৫ এইচ, ৫ এন, ৭ (২), ২৩ (২) সি, ২৩ (২) এফ এবং প্রথম সংবিধির ১৮ ও ১৯ ধারা)। ধারাগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত নিয়ম হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পর্ষদের (সংশ্লিষ্ট বিভাগ/ইনস্টিটিউট ও অনুষদের সুপারিশ অনুযায়ী) সুপারিশের ভিত্তিতে সিন্ডিকেট বিভাগে/ইনস্টিটিউটে প্রয়োজনীয়সংখ্যক পদ সৃষ্টি করবে এবং তা বণ্টন করবে। অথচ বর্তমানে সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারিকৃত আইন অনুযায়ী (সংসদ কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয় আইন পরিবর্তন বা রহিত না করেই) অনেকটা অস্পষ্টভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অথবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দকৃত (বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পর্ষদকে অগ্রাহ্য করে) পদগুলো সিন্ডিকেট বণ্টন করে থাকে। সংশ্লিষ্টদের অজ্ঞতা/অবহেলা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে সঠিক যে পরিপত্র (ইউজিসি/প্রশাঃ/165 (11)/2017/2284) জারি করেছে, তার অন্তত তৃতীয় শর্তের কোনো আইনগত ভিত্তি অন্তত তিয়াত্তরের অ্যাক্ট পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। অর্থাৎ নিয়োগপদ্ধতি নিয়ে শিক্ষা পর্ষদের পরামর্শে সিন্ডিকেটের নীতিমালা প্রণয়ন করতে হলে মহান সংসদে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টের সংশোধন প্রয়োজন পড়বে। এ বছরের ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভার কার্যবিবরণীর অংশবিশেষ [জাবি/রেজিঃ/ক. শা. /৭ (৩)] থেকে দেখা যায়, শিক্ষক নিয়োগের জন্য ‘অনলাইন’ অথবা ‘অনলাইন ও শারীরিক উপস্থিতির সংমিশ্রণে’ পরীক্ষা/সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়কে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় মৌখিক পরামর্শ (লিখিত পরামর্শ গ্রহণ নিরুৎসাহিত করে) প্রদান করেছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এ ধরনের (বুঝে-না বুঝে, জ্ঞাতসারে-অজ্ঞাতসারে) কর্মকাণ্ড ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী ওপরে বর্ণিত পন্থায় সৃষ্ট শিক্ষক পদ পূরণের জন্য বিধি অনুযায়ী পূর্বনির্ধারিত যোগ্যতা নির্ধারণপূর্বক প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সিন্ডিকেট কর্তৃক মনোনীত ছয় (অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদের জন্য) অথবা তিন (অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক ব্যতীত অন্য শিক্ষক পদের জন্য) সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচকমণ্ডলীর মতামতের ভিত্তিতে সিন্ডিকেট শিক্ষক (স্থায়ী অথবা অস্থায়ী পদে) নিয়োগ প্রদান করে থাকেন। এ ছাড়া উপাচার্য মহোদয় সর্বোচ্চ ছয় মাসের জন্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারেন (সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে)। এ আইন রচনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা কল্পনাও করেননি যে এত উচ্চশিক্ষিত, দায়িত্ববান, মানুষ গড়ার কারিগর ও গবেষকদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি প্রার্থীদের যোগ্যতা বিচারে সর্বজনগ্রাহ্য নিয়মকানুন অগ্রাহ্য করবে। তাই আইনের কোথাও যোগ্যতা মূল্যায়নের কোনো পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ কমিটি মনে করলে এবং সিন্ডিকেট অনুমোদন দিলেই শিক্ষক নিয়োগ বৈধ। এখানে লিখিত, অলিখিত, সশরীরে অথবা অনলাইনে যেকোনো পদ্ধতি, যা সংশ্লিষ্ট নির্বাচকমণ্ডলী নির্ধারণ করবে এবং সিন্ডিকেট অনুমোদন করবে, তা–ই আইন অনুযায়ী সিদ্ধ। এমন বাস্তবতায় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন নির্দেশনার ব্যবহারিক দিক অস্পষ্ট ও অপ্রয়োজনীয়।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, নিয়োগের মান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কল্যাণ বিবেচনায় না নিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ, নিছক উপাচার্যের/ব্যক্তিবিশেষের আনুকূল্য অথবা বিরোধিতা ইত্যাদি কারণেই শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে রাজনীতি হয়েছে বেশি। রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক কারণে বিশেষ প্রার্থীর আনুকূল্য অথবা বাদ দেওয়া আমাদের এ নিয়োগপ্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে সবচেয়ে বেশি। এগুলো করতে গিয়ে প্রশাসকদের নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসেন (যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী উপাচার্য নিয়োগের শর্ত এমনভাবে পরিবর্তন করেছেন অথবা এমন সংখ্যা ও মানে নিয়োগ দিয়েছেন, যা আপাত আইনানুগ মনে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় আইনের মুখবন্ধে স্বীকৃত পন্থার পরিপন্থী)।
আইনের ধারা বলবৎ রেখেই আমরা অগ্রহণযোগ্য বিতর্কিত নিয়োগ দিচ্ছি অথবা নিয়োগে বাধা দিচ্ছি। এমন পরিস্থিতিতে যাঁরা এসব নিয়োগের দায়িত্বে আছেন, তাঁদের সদিচ্ছা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনই কেবল মানুষ গড়ার এই প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে পারে। প্রয়োজন কেবল বিবেকতাড়িত হয়ে নিজের বিচার-বুদ্ধির সঠিক ব্যবহার করে কোনো অন্যায্য ব্যক্তি সুবিধার জন্য আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার না করে যথোপযুক্ত প্রয়োগ। এমনকি ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে’ সর্বজনগ্রাহ্য শিক্ষাবিদসহ সমাজের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে কিছু অতি বিতর্কিত নিয়োগ পুনর্বিবেচনা করে যোগ্যতরদের নিয়োগ নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রয়োজন উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদগুলো মনোনয়নে ‘সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সরকারের সঙ্গে যোগাযোগে পারদর্শী’ যোগ্যতার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যোগ্যতর শিক্ষকদের প্রাধান্য দেওয়া, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে আপসহীন থাকবেন। সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যদি চাকরিজীবী মনোভাব পরিবর্তন করে শিক্ষক হয়ে উঠতে না পারেন, তবে কোনো আইন, সংবিধি, বিধি, পরিপত্র জারি বা পরিবর্তন করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যাহত পতন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।
*লেখক: মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার, অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।