অভ্যন্তরীণ অধ্যাপককে পবিপ্রবির উপাচার্য চাই

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ছবি : সংগৃহীত

উপাচার্য হচ্ছে এমন একটি দায়িত্বপূর্ণ পদ, যেই পদে নিয়োজিত ব্যক্তির চিন্তাচেতনা ও কর্মদক্ষতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক কার্যক্রম। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতি কিংবা অগ্রগতি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের দূরদর্শিতার ওপর। তাই উপাচার্যকে হতে হয় সৎ, নৈতিকতাসম্পন্ন, উদ্যমী ও একজন চৌকস একাডেমিশিয়ান এবং এর পাশাপাশি একজন দক্ষ সংগঠক, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণায় সবার আদর্শ হতে পারেন। সে জন্য পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরীণ অধ্যাপকের মধ্যে থেকে একজন শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে দেখতে চাই। যার জন্য কয়েক দিন ধরে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছে। সভা-সমাবেশ এবং মানববন্ধন করছেন অনেকে। যেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা এবং সব পর্যায়ের কর্মচারীরা মিলে তাঁরা চাইছেন যেন তাঁদের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগ হয়। কারণ, নিজেদের শিক্ষক হলে সবকিছু তাঁর চেনাজানা থাকে। গত দুবার নিজস্ব শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সার্বিক অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা অভ্যন্তরীণ শিক্ষকের পক্ষে সহজ হয়; যা অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগ দিলে সম্ভব নয়। তাঁদের চিনতে-জানতে অনেক সময় চলে যায়। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অভ্যন্তরীণ সমস্যা শনাক্ত করতে অনেক সময় পার করে ফেলেন।

অতীতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়, কিন্তু সেসব উপাচার্যের মধ্যে থেকে একজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আছে। যেমন ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ আছে। এমনকি তাঁর মেয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো নিন্দনীয় কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে অভিযোগের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়; যা খুবই নিন্দনীয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টি অনেক পুরোনো। কারণ, এর প্রথম শুরু আশির দশকে। এরপর ১২ জুলাই ২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেক আশা–আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক যোগ্য, আন্তর্জাতিক মানের গবেষক, নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন এবং দক্ষ অধ্যাপকেরা রয়েছেন। যাঁদের অনেকের বিদেশি ডিগ্রি আছে। তাই এমন একজন অভ্যন্তরীণ শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া উচিত, যাঁর সবার কাছে মানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। যাঁর বিদেশি ডিগ্রি এবং নেতৃত্বের গুণাবলি রয়েছে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এমন একজন অধ্যাপককে দ্রুত উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া আমাদের প্রত্যাশা। বিদেশি ডিগ্রি বলছি এ জন্য যে বর্তমান সরকার যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিদেশি ডিগ্রি রয়েছে।

এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে একাডেমিক যোগ্যতার পাশাপাশি খুব গুরুত্ব দেওয়া উচিত উপাচার্য পদপ্রার্থীদের সততার প্রতি। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের মধ্যে একাডেমিক যোগ্যতার কোনো ঘাটতি না থাকলেও সততা ও আত্মসম্মানবোধ নিয়ে নানা সময় প্রশ্ন ওঠে। তাই নিয়োগের পূর্বে উপাচার্য পদপ্রার্থীদের ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে কর্মজীবনের অতীত কর্মকাণ্ডের রেকর্ড খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। একজন সৎ মানুষ তার ছোটখাটো যেকোনো ঘাটতি সময় ও শ্রম দিয়ে পূরণ করতে পারেন কিন্তু সততা ও আত্মসম্মান কোনো কিছু দিয়েই পূরণ করা সম্ভব হয় না।

লেখক

দেশের অপেক্ষাকৃত নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, সাধারণত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগ হয়। অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগের অন্যতম অসুবিধা হলো উপাচার্য নিয়োগকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে অনেকটা সময় নেন।

এই সময়ের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগসন্ধানী একটি সুবিধাবাদী পক্ষের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েন। নানা অনৈতিক কাজকর্ম শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টির নানা রকম ক্ষতি করতে থাকেন। ভাবতে থাকেন যেকোনো কৌশলে চার বছর অতিবাহিত করতে পারলেই তিনি দায়মুক্ত হয়ে যাবেন। কিন্তু এখন আর দায়মুক্তি হয় না, যেমন সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অভিযোগ আনা হয়েছে। সাবেক ওই উপাচার্য অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগ পেয়েছিলেন। অর্থাৎ নিজস্ব বা অভ্যন্তরীণ অধ্যাপককে উপাচার্য চাওয়া পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবিটা খুবই যৌক্তিক এবং প্রাসঙ্গিক। তাই কর্তৃপক্ষের কাছে বিশেষ অনুরোধ জানাই, তাদের দাবিটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে অভ্যন্তরীণ অধ্যাপককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

যোগ্যতার ভিত্তিতে যথাসম্ভব নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টিতেও এখন থেকেই নজর দেওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থাকার পরেও ৬৫ বছর পর্যন্ত সম্মানের সঙ্গে পাঠদান করতে হবে—এই চক্ষুলজ্জার ভয়ে হলেও অনেক উপাচার্যই অনৈতিক কাজ করতে নিরুৎসাহিত হবেন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমি এমন উপাচার্য দেখতে চাই, যিনি হবেন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও সৎ একজন শিক্ষক। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষকদের বিভিন্ন দল–উপদলে বিভক্ত করবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুযোগ–সুবিধা দিয়ে তাদের নিয়ে চলবেন না। যিনি ভাববেন না তিনি মাত্র চার বছরের জন্য এসেছেন, চার বছর পরই তাঁর দায়িত্ব সব শেষ।

উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়কে আপন করে ভাববেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র–শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে চলবেন, যোগ্যতা অনুযায়ী সবার সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করবেন এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে উন্নততর করার সার্বক্ষণিক চেষ্টা করবেন। সর্বোপরি উপাচার্য তাঁরই হওয়া উচিত, যিনি উপাচার্য হয়ে প্রতিটি সিদ্ধান্তের আগে একবার ভাববেন তাঁর প্রতিটি শিক্ষার্থীর কথা, যাঁরা তাঁকে আদর্শ শিক্ষক মনে করেন। আমরা দুঃখের সঙ্গে দেখেছি, অনেকেই উপাচার্য হয়ে তাঁর শিক্ষক সত্তা ভুলে যান।

উপাচার্যদের প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে প্রতিটি কাজের আগে স্মরণ করা উচিত সবার আগে তিনি একজন মহান শিক্ষক, তারপরে একজন প্রশাসক উপাচার্য। পরিশেষে, উপাচার্য নিয়োগে একাডেমিক এক্সিলেন্সি; গবেষণায় দক্ষতা—যেমন আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে কয়টি প্রকাশনা আছে; সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা; একই সঙ্গে তাঁদের যে প্রতিষ্ঠান, সেখানে শিক্ষক সমিতির পদে নেতৃত্ব দিয়েছেন কি না এবং প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয় গভীরভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। কারণ, উপাচার্য শুধু একাডেমিক বিষয়টি দেখেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক বিষয়ে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ এবং নির্দেশনা দিতে হয়। তাই একজন উপাচার্যের নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টিও জরুরি।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞানও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়,