অভিভাবকহীন বিশ্ববিদ্যালয়, সংকটের কারণ দলীয়করণ

  • দেশে চালু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি।

  • ২৭ জন উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন।

  • ১২ জন সহ–উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন।

  • ৭ জন কোষাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন।

ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য (ভিসি), সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ শীর্ষ পর্যায়ে শিক্ষক-কর্মকর্তারা পদত্যাগ করছেন। তাঁরা সবাই বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া।

এই পরিস্থিতিতে ‘অভিভাবকহীন’ হয়ে পড়া এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে না। নতুন নিয়োগও দেওয়া শুরু হয়নি।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারের সংকটের বড় কারণ দলীয়করণ। বিগত সরকারগুলোর আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ শীর্ষস্থানীয় পদে দলীয় আনুগত্য রয়েছে, এমন শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব সময় দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। ক্ষমতাসীন দলগুলোর ছাত্র সংগঠনও এই সুযোগে ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলে প্রভাব বিস্তার করে। এমন পরিস্থিতির ভুক্তভোগী হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এসব অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে গ্রহণযোগ্য শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বর্তমানে দেশে ৫৫টি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ৪টি। বাকি ৫১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকার বিদায়ের পর গত মঙ্গলবার পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২৫ জন উপাচার্য, ১২ জন সহ-উপাচার্য এবং ৭ জন কোষাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন। গতকাল বুধবার আরও দুটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। সব মিলিয়ে ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (অধিভুক্ত কলেজসহ) ৪৪ লাখের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে ‘অভিভাবকহীন’ হয়ে পড়া এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে না। নতুন নিয়োগও দেওয়া শুরু হয়নি।

সরকার পতনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা প্রশাসনকে দলীয় মুক্ত করার দাবিও তুলছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে দেশের ১১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, দুটি সরকারি কলেজ ও ৬টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টিতে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান সংকটের বিষয়টি গতকাল সচিবালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সংবাদ সম্মেলনেও উঠে এসেছে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ৪৫টির মতো বিশ্ববিদ্যালয় এখন অভিভাবকহীন। শিক্ষাগত যোগ্যতা, ব্যক্তিত্ব, প্রশাসনিক দিক দিয়ে সবার কাছে, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য শিক্ষকদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এরপর যত দ্রুত সম্ভব অন্তত প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ দলীয়ভিত্তিক প্রশাসন চান না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

চার স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৭৩ সালের আদেশে চলা ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সিনেটে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনজনের একটি প্যানেল ঠিক করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি এই প্যানেল থেকে একজনকে উপাচার্য নিয়োগ করেন।

যদিও নিয়মটির আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় সরকারের আমলেই ব্যত্যয় হয়েছে। দেখা যায়, আদেশের অন্য একটি ধারার সুযোগে উপাচার্য প্যানেল ছাড়াই একজন শিক্ষককে সরাসরি সাময়িক সময়ের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। ক্ষমতায় থাকা দলের সমর্থক শিক্ষকনেতা বা শিক্ষক উপাচার্য হন। তারপর দীর্ঘদিন ধরে তিনি দায়িত্ব পালন করে যান। পরে সুবিধাজনক অবস্থায় উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করে আবার তিনিই উপাচার্য হন।

গতকাল বুধবার আরও দুটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। সব মিলিয়ে ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের তথ্য পাওয়া গেছে।

যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য পদত্যাগ করা উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল গত বছরের ১৫ অক্টোবর উপাচার্য পদে নিয়োগ পান। দায়িত্ব নেন ওই বছরের ৪ নভেম্বর। কিন্তু ৯ মাসেও উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হয়নি। তাঁর আগের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানকে প্রথমে ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর উপাচার্য পদে সাময়িক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রায় দুই বছর পর ২০১৯ সালে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করে আবার তিনি উপাচার্য হন। তাঁরা দুজনই আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষক নেতা ছিলেন। উপাচার্য নিয়োগে বিএনপি সরকারের আমলেও এমন ঘটনা আছে।

ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আবু তাহের এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম পদত্যাগ করেছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (রুটিন দায়িত্ব) এ বি এম আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্য, সহ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ না থাকায় বলা যায়, প্রায় সব ধরনের কাজ বন্ধ রয়েছে। উপাচার্য না থাকায় কোনো ফাইল সই করা যাচ্ছে না। হলের প্রাধ্যক্ষদেরও নতুন করে দায়িত্ব দেওয়া যাচ্ছে না। শুধু উপাচার্য থাকলেও কাজগুলো চালিয়ে নেওয়া যেত। এই মুহূর্তে উপাচার্য নিয়োগ জরুরি।

ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আবু তাহের এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম পদত্যাগ করেছেন।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

বর্তমানে ৫১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। এর মধ্যে অন্তত ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত তিন মেয়াদে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে কোনো প্যানেল নির্বাচন হয় না। সরকারের প্রস্তাব অনুযায়ী উপাচার্য নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সময় নিয়োগ, জমি অধিগ্রহণসহ নানা বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের আত্মীয়স্বজনের নিয়োগ নিয়ে নানা অনিয়ম হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন আছে।

ইতিমধ্যে ২২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা পদত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে গতকাল যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার হোসেন এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাফিজা খাতুন পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগ করা উপাচার্যদের মধ্যে আরও আছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মশিউর রহমান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমদাদুল হক চৌধুরী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এফ এম আবদুল মঈন প্রমুখ। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদারও পদত্যাগ করেছেন।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সময় নিয়োগ, জমি অধিগ্রহণসহ নানা বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের আত্মীয়স্বজনের নিয়োগ নিয়ে নানা অনিয়ম হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন আছে।

করণীয় নিয়ে আলোচনা

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ উচ্চশিক্ষায় নানামুখী সংস্কারের প্রত্যাশা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। গত সোমবার ঢাকায় ‘কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই? বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার ভাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনার আয়োজন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নামে শিক্ষকদের একটি মোর্চা। ওই আলোচনায় উঠে আসে সব স্তরে দলীয় আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। সরকারকে উদার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের মতো চলতে দিতে হবে। প্রশাসনের পদে থাকা শিক্ষকদের সমিতির নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব ক্ষমতা উপাচার্যের হাতে না রাখার প্রস্তাবও করা হয়।

চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের কারণে গত ১৭ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একের পর এক উপাচার্যসহ বিভিন্ন পদ থেকে পদত্যাগের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়–সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রায় সব উপাচার্যকেই পর্যায়ক্রমে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়েও উপাচার্য নিয়োগ করতে পারেনি সরকার।

সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি অভিন্ন পদ্ধতি ঠিক করে গণতান্ত্রিক উপায়ে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে। এখানে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ থাকবে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ

সরকারি সূত্রগুলো বলছে, উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে একধরনের টানাপোড়েন চলছে। সরকারের কারও কারও চাওয়া, প্রথাগতভাবে দলীয় শিক্ষকদের উপাচার্য না করে তুলনামূলক অধিক যোগ্য ও সুনাম আছে এমন ব্যক্তিদের উপাচার্য করা দরকার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের চাওয়া, তাঁদের মধ্য থেকে যেন উপাচার্য নিয়োগ করা হয়।

উপাচার্য নিয়োগের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, বিগত সরকারের আমলে যে কয়টি প্রতিষ্ঠানের বেশি ক্ষতি করা হয়েছে, তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। দেখা যেত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা নিয়োগ পেতেন না। এখন বিধিবিধান অগ্রাহ্য করে নিয়োগ দেওয়ার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি অভিন্ন পদ্ধতি ঠিক করে গণতান্ত্রিক উপায়ে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে। এখানে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ থাকবে না। এখন অস্থায়ী ভিত্তিতে দ্রুত যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের উপাচার্য নিয়োগ করা উচিত। তবে এই নিয়োগের সময় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন পদ্ধতিতে উপাচার্য নিয়োগের ঘোষণাটি দিতে হবে।