জার্মানিতে পড়াশোনার খরচ ও ভিসা প্রক্রিয়া কেমন: পর্ব ৩

বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ জার্মানি। তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রসরমাণ এ দেশ শিক্ষাসহ নানা দিক দিয়ে ইউরোপের শীর্ষে। দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত আধুনিক ও যুগোপযোগী। আছে বিশ্বের অনেক নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়। জার্মানিতে পড়াশোনা নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের চার পর্বের তৃতীয় পর্ব পড়ুন আজ—

ফাইল ছবি

বর্তমান সময়ে জার্মানিতে উচ্চশিক্ষায় সব থেকে বড় বাধা হচ্ছে জার্মান দূতাবাসে ভিসা সাক্ষাৎকার ও ভিসা পেতে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, যা তৈরি হয়েছে করোনাকালে দীর্ঘ সময় জার্মান দূতাবাস ও জার্মানিতে অবস্থিত বৈদেশিক প্রশাসন অফিসের কর্মকাণ্ড বন্ধের মধ্য দিয়ে।

এ জট দূতাবাস এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই শিক্ষার্থীদের একরকম ধৈর্যের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। বর্তমানে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ডেট নেওয়ার পর ক্ষেত্রবিশেষে ভিসা পেতে দেড় থেকে দুই বছর লেগে যায়। অর্থাৎ প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তিন থেকে চার সেমিস্টার লস করে তবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাজির হতে হয়। যদিও করোনা–পরবর্তী সময় অনলাইন ক্লাস সিস্টেমের জন্য অনেক শিক্ষার্থী দেশে থেকেই ভর্তি হয়ে ক্লাস করে পরীক্ষা দিয়ে অনেক কোর্স শেষ করে ফেলেছিলেন। পরে অনলাইন সিস্টেম বাতিল হওয়ার পর জট সমস্যা দেখা দেয়। এ জন্য অ্যাডমিশন লেটার পাওয়ার পর প্রথম কাজ হচ্ছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার জন্য নিচের ওয়েব অ্যাড্রেসে ক্লিক করুন—

এবার আসছি জার্মানিতে উচ্চশিক্ষায় খরচের ব্যাপারে। বিশ্ববাজারের দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার মুদ্রাস্ফীতির জন্য খরচ বেশ কিছুটা বেড়ে গেছে। এ খরচ বলতে মূলত ব্লক মানি বোঝায়। আপনি বিভিন্ন উপায়ে টাকা জার্মান অ্যাকাউন্টে ব্লক করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সব থেকে স্টুডেন্ট ফ্রেন্ডলি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কোরাকল। নিচের এ ওয়েবসাইটে গেলে খুব সহজেই আপনি ব্লক মানির জন্য অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন।

ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স কোরাকল থেকে না করতে চাইলে দেশি অনেক ইনস্যুরেন্স কোম্পানি দিয়েও করিয়ে নিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে আপনাকে জার্মান দূতাবাস, ঢাকার কিছু মার্ক করা ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে ইনস্যুরেন্স করিয়ে নিতে হবে। কোম্পানিভেদে ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স করতে ৪ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে। দূতাবাস ওয়েবসাইটে সার্চ দিলে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির তালিকাগুলো পাবেন।

মজার বিষয় হচ্ছে, কোরাকল ইনস্টিটিউট আপনাকে জার্মানির হেলথ ইনস্যুরেন্স ও ট্রাভেল ইনস্যুরেন্সের ব্যাপারেও হেল্প করবে। তারা খুবই কো–অপারেটিভ এবং ফ্রেন্ডলি কমিউনিকেট করে আপনার ইনস্যুরেন্স ও ব্লক মানি–সংক্রান্ত বিষয়গুলো সমাধান করতে হেল্প করবে। জার্মানিতে হেলথ ইনস্যুরেন্স বাধ্যতামূলক, তাই আপনাকে জার্মানিতে থাকতে হলে হেলথ ইনস্যুরেন্সের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে।

ফাইল ছবি

বর্তমানে ব্লক মানির পরিমাণ হচ্ছে ১১ হাজার ২০৮ ইউরো (প্রায় ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা)। কোরাকলে অ্যাকাউন্ট খোলার পর ওরা আপনাকে একটা কনফারমেশন দিবে। সেটা নিয়ে বাংলাদেশের যেকোনো বৈদেশিক সেবাদানকারী ব্যাংকে স্টুডেন্ট ফাইল খুলে ওই পরিমাণ টাকা স্টুডেন্ট ফাইলে জমা করে দিলে বাংলাদেশের ব্যাংক টাকার পরিমাণ ইউরোতে পরিবর্তন করে কোরাকলের জার্মান অ্যাকাউন্টে ব্লক মানি হিসেবে গচ্ছিত রাখবে।

পরবর্তীকালে জার্মানিতে নরমাল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট (ডয়েচে ব্যাংক, জালে স্পার্কাসে, কমার্স ব্যাংক, পোস্ট ব্যাংক ইত্যাদি) খোলার পর কোরাকলকে কনফার্ম করে দিলে প্রতি মাসে আপনার নরমাল সেভিংস অ্যাকাউন্টে ৯৩৪ ইউরো করে জমা হতে থাকবে। এ ব্লক মানির অর্থ হচ্ছে আপনি জার্মানিতে জীবন যাপন করার সামর্থ্য রাখেন। যদিও পার্টটাইম জব করে নিজের খরচ নিজেই চালাতে পারবেন। তারপরও আপনার নিরাপত্তার স্বার্থেই এই সেভিংস ইউরো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

আরও পড়ুন
ফাইল ছবি

উল্লেখ্য, ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স কোরাকল থেকে না করতে চাইলে দেশি অনেক ইনস্যুরেন্স কোম্পানি দিয়েও করিয়ে নিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে আপনাকে জার্মান দূতাবাস, ঢাকার কিছু মার্ক করা ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে ইনস্যুরেন্স করিয়ে নিতে হবে। কোম্পানিভেদে ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স করতে ৪ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে। দূতাবাসের ওয়েবসাইটে সার্চ দিলে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির তালিকাগুলো পাবেন। ইনস্যুরেন্স কোম্পানির তালিকা পেতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন।

এবার আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে ডকুমেন্ট সাবমিশন ই–মেইল পাওয়ার জন্য। এ ক্ষেত্রে অপেক্ষমাণ সময়কাল পূর্বে বর্ণিত সময় যেমন দেড় বছর থেকে দুই বছর পর্যন্ত লাগতে পারে, সুতরাং হতাশ হবেন না বরং ধৈর্যশীল হতে হবে। এ দীর্ঘ অপেক্ষার মধ্যেই আপনার কাজ হচ্ছে নিচের তালিকা অনুযায়ী একটা পিডিএফ ডকুমেন্টের কপি প্রস্তুত করে কম্পিউটারে জমা করে রাখা।

আরও পড়ুন

পিডিএফ কপির ডেটাগুলো যেভাবে সাজাবেন—

১. ভিসা আবেদনপত্রে অনলাইন ফরম পেতে এখানে ক্লিক করুন অথবা অফলাইন ফরমের জন্য এখানে ক্লিক করুন

২.

বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট ফটো। ফটো ফরমেট জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন
https://www.germany.info/blob/929404/6e3eee9fd4d86e16aaefe0e92d809332/visa-photo-examples-data.pdf

৩. পাসপোর্টের ডেটা পেজ।

৪. জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অনুমতিপত্র (অ্যাডমিশন লেটার), ভর্তির প্রমাণপত্র (যদি অনলাইনে ভর্তি হয়ে থাকেন), তাদের ভাষাবিষয়ক যোগ্যতার লিখিত অনুমতিপত্র (এটি পেতে কোর্স কো–অর্ডিনেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে)।

৫. ব্যাচেলর ও মাস্টার্স (যদি থাকে) পরীক্ষার সনদ ও ট্রান্সক্রিপ্ট।

৬. এইচএসসি পরীক্ষার সনদ ও ট্রান্সক্রিপ্ট।

৭. লেটার অব মোটিভেশন।

৮. সিভি।

৯. ইংরেজি বা জার্মান ভাষায় দক্ষতার সনদ (আইইএলটিএস, টেল্ক)

১০. ব্লক মানি ডকুমেন্টস।

১১. হেলথ ইনস্যুরেন্স ডকুমেন্টস।

১২. ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স ডকুমেন্টস।
ডকুমেন্ট সাবমিশন ই–মেইলের ফিরতি ই–মেইলে (রিপ্লাই অপশন) যত দ্রুত সম্ভব (সম্ভব হলে দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই) কম্পিউটারে জমা করে রাখা পিডিএফ কপি সংযুক্ত করে পাঠিয়ে দিবেন। এরপর আপনাকে ভিসা ইন্টারভিউ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ডেটের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। জার্মান দূতাবাস থেকে মোটামুটি ১০ দিনের মধ্যে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ডেট পাবেন।

জার্মান দূতাবাসের চেকলিস্ট অনুযায়ী মূল কাগজপত্র এক সেট সাজাতে হবে। এ ছাড়া চেকলিস্ট অনুযায়ী সব কাগজপত্র দুই সেট ফটোকপি করে আলাদা করে সাজাতে হবে।

আরও পড়ুন
ফাইল ছবি

চেকলিস্ট দেখতে ক্লিক করুন

জার্মান দূতাবাসে সাক্ষাতের সময় সঙ্গে নিতে হবে আনুমানিক ৯ হাজার টাকা। এটি আসলে ভিসা প্রসেস ফি’র ইউরো হিসাবে যে টাকা আসে, সেই হিসাবটা বললাম। ভিসা প্রসেস ফি ৭৫ ইউরো।

ভিসা ইন্টারভিউয়ের ১০ থেকে ১৫ মিনিট জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। খুব মাপকাঠি বজায় রেখে প্রশ্নকর্তার সব প্রশ্নের উত্তর মার্জিতভাবে দিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করতে হবে যে জার্মানিতে পড়াশোনা করাই আপনার একমাত্র উদ্দেশ্য। মনে রাখতে হবে তিনি আপনার ভিসা ইচ্ছা করলে তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে বাতিল করে দিতে পারেন।

প্রশ্নকর্তার সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ করে যদি সব কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকে এবং তিনিও আপনার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হোন, তখন তিনি আপনার মূল কাগজপত্র ফিরিয়ে দিয়ে ফটোকপি করা কাগজগুলো রেখে দেবেন।

আরও পড়ুন

এরপর আপনার অপেক্ষার পালা। সবকিছু ঠিক থাকলে আশা করি, সর্বোচ্চ ৪০ দিনের মধ্যে ৩ মাসের জন্য জার্মানির ভিসা পেয়ে যাবেন। হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

পরবর্তীকালে জার্মানিতে আসার পর হোম অ্যাড্রেস কনফারমেশন, সিটি রেজিস্ট্রেশন, ভার্সিটি ইনরলমেন্ট কনফারমেশন, জার্মান হেলথ ইনস্যুরেন্স, ব্লক করা টাকার আপডেটেড ডকুমেন্টস দেখিয়ে এক থেকে দুই বছরের জন্য ভিসা পাবেন নিশ্চিন্তে পড়াশোনা, গবেষণা ও পার্টটাইম জব করার জন্য৷ চলবে.

  • আগামীকাল শেষ পর্ব পড়ুন: জার্মানিতে ডক্টরাল পজিশন ও স্কলারশিপের জন্য যা করতে হবে

  • লেখক: মাহবুব মানিক, গবেষক, প্লাস্টিক ও রাবার প্রকৌশল, মের্জেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স, মের্জেবুর্গ, জার্মানি