অষ্টম শ্রেণিতে ঝরে পড়া রুমা দেবী হার্ভার্ডের অতিথি বক্তা
আপনি কি তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত কাউকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন? এই অবিশ্বাস্যকেই বিশ্বাস্য করে দেশের জন্য গর্ব বয়ে এনেছেন ভারতের রাজস্থানের রুমা দেবী। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে ছোটবেলায়ই স্কুল ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। শিগগিরই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছেন তিনি। আজ আমরা তাঁর অসাধারণ যাত্রার কথা জানব।
রাজস্থানের বারমেরে জন্ম রুমা দেবীর। ছোটবেলায় চার বছর বয়সে মাকে হারান। মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন পর রুমা দেবীর বাবা তাঁর দায়িত্ব মামা–মামিকে দিয়ে দেন। মামা–মামি তাঁকে পড়াশোনা করাতে আগ্রহী ছিলেন না। ছোটবেলা থেকেই তাঁর দাদির কাছ থেকে সেলাই এবং সূচিকর্মের কাজ শিখেছিলেন। তাঁর দাদি রাজস্থানের এমব্রয়ডারির কাজ খুব ভালো জানতেন। দাদির কাছেই তাঁর ওই কারিগরি শিক্ষার শুরু। এটাতেই গড়েন তিনি নিজের ভাগ্য।
বাড়ির কাজ আর স্কুলের পাশাপাশি এমব্রয়ডারি শেখা চলতে থাকে। এরই মধ্য অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, উচ্চবিদ্যালয় ছিল বাড়ি থেকে অনেক দূরে। আর তারপরই অবধারিতভাবে বাড়ি থেকে দেখা পাত্রের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। বয়স তখন মাত্র ১৭। এরপর প্রথম সন্তান জন্মের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই রুমা হারান তাকে। এই ঘটনা তাঁর জীবন বদলে দেয়। সন্তানের শোক ভুলতে তিনি ছোট থেকে শেখা এমব্রয়ডারি, সুইসুতার আশ্রয় নেন।
সেলাই এবং সূচিকর্মে ভালো হলেও বাইরে কাজ করার সুযোগ পাননি কখনো। তিনি শুধু নিজের পোশাক তৈরি করতেন। তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কৃষিকাজে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু বর্ষার সময় তাঁরা পর্যাপ্ত উপার্জন করতে পারতেন না। ঘরের এই আর্থিক অবস্থা দেখে অর্থ উপার্জনের চিন্তা শুরু করেন রুমা দেবী। শ্বশুরবাড়ির পাশের আরও দুজন নারীকে কাজ করতে রাজি করান। কাজটি সহজ ছিল না।
কারণ, সেই সমাজে মেয়েরা বাড়ির বাইরে কাজে যায় না। বাড়ির লোকজনের সঙ্গে একপ্রকার বিরোধিতা করেই গ্রামের নারীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করেন।
২০০৬ সালের ঘটনা। রুমা দেবীসহ ১১ জন নারী ১০০ রুপি দিয়ে কেনেন পুরোনো সেলাই মেশিন।
সেলাই এবং সূচিকর্মের কাজ শুরু করেন। শুরুতে তাঁরা ব্যাগ ও কুশন কাভার তৈরি করেন। সঙ্গে দেখা শুরু করেন স্বপ্ন। রুমা দেবী তাঁদের কাজ শেখান এবং দক্ষ করে তোলেন। এরই মধ্য তিনি আশপাশের ৩০ হাজারের বেশি গ্রামীণ নারীকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলেন। তাঁদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিও করে দেন। গ্রামীণ উন্নয়ন ও চেতনা সংস্থার মাধ্যমে রুমা দেবী অনেক কাজ পান। নিজের পাশাপাশি অন্যের জীবন গড়ে দেন তিনি।
২০১০ সালে রুমা দেবী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাঁরা সেই সময় দিল্লির রফি মার্গে প্রথম নিজেদের হাতে তৈরি জিনিসের প্রদর্শনী করেন। সেই প্রথম রুমা দেবীর বারমেরের বাইরে যান। সেবার ১০ থেকে ১১ হাজার রুপির বিক্রি তাঁকে উৎসাহিত করে তোলে। পরের বছর আবার ওই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। অপূর্ব সেই সব কারুকাজ মোট ১১ লাখ রুপিতে বিক্রি হয়ে যায়। এই সময় স্বাভাবিক নেতৃত্বদানের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রুমা নিজ গ্রাম আর আশপাশের গ্রামের নারীদের সংগঠিত করেন আরও বেশি কাজ ও স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে।
রুমা দেবীর জীবনের এই উত্থান এবং সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলার গল্প শুনবেন শিক্ষার্থীরা।
সেই গল্প বলতে তাঁকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডেকেছে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়। একটি রাজস্থানের জয়পুরের বেসরকারি মাহাত্মা জ্যোতি রাও ফুলে ইউনিভার্সিটি। অন্যটি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি। এই বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক এক সম্মেলনে অষ্টম শ্রেণির পর ঝরে পড়া রুমা দেবী নিজের জীবনের গল্প শোনাবেন। তিনি জার্মানি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে এরই মধ্য বক্তৃতা দিয়ে বেরিয়েছেন। এরই মধ্য রুমা দেবীর জীবনের গল্প খালিজ টাইমসে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৮ সালে ইন্ডিয়া টুডের ‘অ্যানিভারসারি এডিশন’–এ তাঁর ছবি, ২০১৯ সালে ‘টিএফআই ডিজাইনার অব দ্য ইয়ার’ সম্মান পেয়েছেন। তিনি ভারতের নারীদের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘নারী শক্তি পুরস্কার ২০১৮’ পেয়েছেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক গণমাধ্যম খালিজ টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একসময় রুমা দেবী বলেছিলেন, ‘ফ্যাশন ডিজাইনিং এবং ফ্যাশন শোতে অংশ নেওয়া আপনার পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়, তবে আপনি সেলাই দিয়ে সেটি করতে পারছেন।’ তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও নিউজ এইটিন