জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির শুরুতেই সেশনজটে শিক্ষার্থীরা, অভিযোগ গাফিলতির
চলতি বছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন আল আমিন ও সুমন হোসাইন। আল আমিন ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে। আর সুমন হোসাইন ভর্তি হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। আল আমিন এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা দিচ্ছেন, সহপাঠীদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আর সুমন হোসাইনের অলস সময় কাটছে গ্রামের বাড়িতে। কারণ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ক্লাস শুরু হয়নি। আসলে ক্লাস শুরুর তারিখও নির্ধারণ হয়নি। সুমন জানেনও না কবে ক্লাস শুরু হবে। এমনকি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ক্লাস শুরুর বিষয়ে নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি। এ কারণে ভর্তির শুরুতেই সেশনজটে পড়তে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে গত ১৬ আগস্ট। রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এখনো ক্লাস শুরুর তারিখ ঘোষণাই করতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সহ–উপাচার্য (শিক্ষা) মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ প্রথম আলোকে বলেন, আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শিক্ষার্থীদের আসন বরাদ্দ না দিয়ে হলে ওঠানো যাচ্ছে না। ফলে ক্লাস শুরুর ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম একটু দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে হয়ে থাকে। এটাও একটা অন্যতম কারণ। আমরা চেষ্টা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এ সমস্যা সমাধান করে আরেকটু আগে ক্লাস শুরু করার।’
শিক্ষার্থী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, শুধু চলতি শিক্ষাবর্ষে নয়, প্রতিবছরই বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষাবর্ষে ক্লাস শুরু হয় অপেক্ষাকৃত দেরিতে। প্রতিবছর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হওয়ার তিন থেকে পাঁচ মাস পর ক্লাস শুরু করে কর্তৃপক্ষ। তবে হলে আসন বরাদ্দের যে কথা বলে শিক্ষার্থীদের দেরিতে ক্লাস শুরু হয়, কোনো বছরই সবার আসন দিতে পারেনি তারা। নতুন শিক্ষার্থীদের উঠতে হয়েছে গণরুমে। দেরিতে ক্লাস শুরু হওয়ায় তৈরি হয়েছে সেশনজট।
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করলেও জাহাঙ্গীরনগরের একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা বের হন আরও পরে।
ছাত্র ইউনিয়ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমর্ত্য রায় প্রথম আলো বলেন, ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেশনজট দীর্ঘতর হচ্ছে। এখনো প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু করতে না পারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লজ্জার। জনগণের টাকায় চলা বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্টেক হোল্ডারদের যথোপযুক্ত ভবিষ্যৎ তৈরি করতে না পারে, নতুন জ্ঞানের পথ মসৃণ না করতে পারে, তখন তা আর বিশ্ববিদ্যালয় থাকে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ক্লাস শুরু হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। যাঁদের মধ্যে চারুকলা বিভাগ বাদে সব বিভাগেরই স্নাতকোত্তর শেষ হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও একই শিক্ষাবর্ষে ৮০ শতাংশ বিভাগের স্নাতকোত্তর শেষ। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একই শিক্ষাবর্ষে ক্লাস শুরু হয় ২০১৭ সালের ৯ মার্চ। এর মধ্যে সাংবাদিকতা ও আইন বিভাগ ছাড়া অন্য কোনো বিভাগে এখনো স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শুরু করতে পারেনি। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয় গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই একই শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হয় ৫ মাস পর চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি।
এর আগে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয় ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি। ওই একই শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস শুরু হয় ২০২২ সালের ৯ মার্চ। অনলাইনে ক্লাস শুরুর বিষয়ে প্রশাসন কারণ হিসেবে দেখিয়েছিল নির্মাণাধীন হল উদ্বোধন করে আস বরাদ্দ দিয়ে সশরীর ক্লাস শুরু হবে। যদিও অনলাইনে দুই মাস ক্লাস করার পর ওই ব্যাচের সশরীর ক্লাস শুরু হয়; তখনো তাঁদের ঠাঁই মেলে গণরুমে। তাঁদের মধ্যে এখনো অনেকেই গণরুমে থাকেন।
জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গাফিলতিতে প্রতিবছর দেরিতে ক্লাস শুরু হয়। এটা একধরনের ‘অপসংস্কৃতিতে’ পরিণত হয়েছে। এতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিছিয়ে পড়ছেন তাঁরা। তৈরি হচ্ছে সেশনজট।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মঞ্চের আহ্বায়ক দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যেখানে চেষ্টা করছি সেশনজট কমানোর, সেখানে নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা শুরুতেই পিছিয়ে পড়ছে। ভর্তি পরীক্ষার পর ক্লাস দেরিতে শুরু করার কোনো কারণ দেখি না। এটা শুধুই প্রশাসনের গাফিলতি ছাড়া কিছু না।’
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. নূরুল আলমের কার্যালয়ে গত রবি ও সোমবার সশরীর যোগাযোগ করা হলে তিনি শিক্ষক পদোন্নতি বোর্ডের সভায় আছেন বলে জানান তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।