কানাডা বিদেশি শিক্ষার্থী কমানোয় কারা প্রভাবিত হবেন
আগামী দুই বছরের জন্য বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমিয়ে আনার নতুন একটি নীতি ঘোষণা (ক্যাপ) করেছে কানাডার সরকার। দেশটিতে আবাসন ও স্বাস্থ্য খাতের যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা সামলাতেই শিক্ষার্থী ভিসা দেওয়ার হার কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কানাডার অভিবাসনমন্ত্রী মার্ক মিলার বলেছেন, রেকর্ডসংখ্যক অভিবাসী আসা এবং এর ফলে দিন দিন আবাসনসংকট তীব্র হওয়ায় বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এ বিধিনিষেধ আরোপ করছে কানাডা। আগামী দুই বছরের জন্য এ প্রক্রিয়া বহাল থাকবে। ২০২৫ সালে শেষে আবার এ সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা শেষে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এখন প্রশ্ন, নতুন এ পরিকল্পনা কীভাবে কাজ করবে এবং কারা ঝুঁকিতে রয়েছেন।
এ ক্যাপ বা প্রক্রিয়া সম্পর্কে কী জানি
২০২৪ সালে নতুন ভিসা দেওয়া হবে ৩ লাখ ৬৪ হাজার; গত বছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ কম। ২০২৩ সালে প্রায় ৫ লাখ ৬০ হাজার ভিসা ইস্যু করা হয়েছিল। নতুন এই নিয়মের ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য স্নাতকোত্তরের পরে ওয়ার্ক পারমিটের সীমাও নির্ধারণ করা থাকবে, যা সম্ভবত শিক্ষার্থীদের নিজ দেশে ফিরে যেতে উত্সাহিত করবে। শিক্ষার্থীদের কাজের অনুমতিপত্রকে আগে স্থায়ী বসবাসের জন্য একটি সহজ পথ হিসেবে দেখা হতো।
কানাডা সরকারের নতুন এই নীতি কেবল দুই বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা বা স্নাতক পর্যায়ের প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। যাঁরা বর্তমানে সেখানে পড়াশোনা করছেন, তাঁদের স্টাডি পারমিট (কাজের অনুমতিপত্র) নতুন করে নবায়নের ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব পড়বে না।
কীভাবে ক্যাপ প্রয়োগ হবে
কানাডা সরকার ২০২৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ওয়ার্ক পারমিটের ক্যাপ পুনর্মূল্যায়নের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে; যদিও এটি প্রাথমিকভাবে স্নাতক প্রোগ্রামগুলোকে প্রভাবিত করবে। কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন স্নাতক, পেশাদার এবং ডক্টরাল শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
পোস্টগ্র্যাজুয়েট (স্নাতকোত্তর) ওয়ার্ক পারমিট
এ বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে যেসব আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অধ্যয়ন প্রোগ্রাম শুরু করবেন, তাঁরা স্নাতক হওয়ার পরে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন ওয়ার্ক পারমিটের জন্য যোগ্য হবেন না। মাস্টার্স ও স্নাতক স্তরের প্রোগ্রামের স্নাতকেরা ৩ বছরের ওয়ার্ক পারমিটের জন্য আবেদন করার যোগ্য হবেন।
স্বামী/স্ত্রীর ওয়ার্ক পারমিট
মাস্টার্স ও তার ওপরের লেভেলের, যেমন পিএইচডি ও পোস্টডক্টরেট শিক্ষার্থীদের স্বামী বা স্ত্রীকে (স্পাউস) শুধু ওপেন ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হবে। অন্য স্পাউসদের ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হবে না।
প্রদেশ অনুসারে কোটা ও বণ্টন
কানাডার প্রাদেশিক সরকারগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে তাদের প্রদেশের জন্য নির্ধারিত সংখ্যা পাওয়ার পর প্রদেশের কলেজ ও ইউনিভার্সিটিগুলোর সঙ্গে বসে প্রতিটির জন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ঠিক করবে। এ বিষয়ে মার্ক মিলার বলেছেন, কিছু কিছু প্রদেশে প্রায় ৫০ ভাগ বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাবে। তবে এখন যাঁরা কানাডায় পড়াশোনা করছেন, তাঁদের পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে যদি ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, তাঁরা এ সংখ্যার ক্যাপের আওতায় পড়বেন না। এর পাশাপাশি কানাডায় নতুন গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট প্রাইভেট কলেজ থেকে বিদেশি শিক্ষার্থীদের কমিয়ে আনার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব কলেজের বিরুদ্ধে পড়াশোনার নিম্নমান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আনার অভিযোগ রয়েছে।
তবে কোন প্রদেশ ও টেরিটরিতে কতজন করে বিদেশি শিক্ষার্থী আনতে পারবে, তা এখনো ঠিক করা হয়নি। শিগগিরই তাদের বর্তমান শিক্ষার্থীদের সংখ্যা হিসাব করে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন সংখ্যা জানিয়ে দেবে প্রদেশগুলোকে।
প্রয়োজন প্রত্যয়ন
এ বিধিনিষেধের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের প্রদেশগুলো থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র প্রদানের জন্য ফেডারেল সরকারের অনুমতিতে আবেদন করতে হবে। গত ২২ জানুয়ারি থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বেশির ভাগ স্টাডি পারমিট অ্যাপের জন্য নির্বাচিত প্রদেশ/অঞ্চল থেকে একটি প্রত্যয়নপত্রের প্রয়োজন পড়ছে। একটি প্রক্রিয়া ৩১ মার্চে শেষ হয়ে যাবে।
কার কার স্টাডি পারমিটের জন্য চিঠির প্রয়োজন নেই—
অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু, যারা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার জন্য আবেদন করছে (কিন্ডারগার্টেন থেকে গ্রেড-১২)
যে শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর, পিএইচডি বা অন্য স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামের জন্য আবেদন করছেন
যে শিক্ষার্থী তাঁদের স্টাডি পারমিট বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছেন।
সরকার কেন এ সিদ্ধান্তে যাচ্ছে
জাস্টিন ট্রুডো সরকার এমন এক সময়ে এ সিদ্ধান্তের কথা জানাল, যখন তাঁর সরকার উচ্চমূল্যের আবাসন সমস্যা মোকাবিলায় চাপের মুখে রয়েছে। কানাডায় একটি বাড়ির দাম এখন গড়ে ৭ লাখ ৫০ হাজার কানাডিয়ান ডলার। এ ছাড়া গত দুই বছরে দেশটিতে প্রায় ২২ শতাংশ বাড়িভাড়া বেড়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেশব্যাপী বাড়িভাড়া এক বছরের আগের তুলনায় ৭ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে। এ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনে দেশটির অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ। তাঁরা বলছেন, কানাডায় যেভাবে অভিবাসী বেড়েছে, সে অনুপাতে বাড়ি তৈরি হয়নি। ফলে বাসাভাড়া ও বাড়ির দাম—উভয়ই বেড়েছে। কানাডার জাতীয় আবাসন সংস্থা কানাডা মর্টগেজ অ্যান্ড হাউজিং করপোরেশন বলছে, বাড়ির দাম এবং বাড়িভাড়া সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে আনতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটিতে আরও প্রায় ৩৫ লাখ ঘর নির্মাণের প্রয়োজন হবে।
কাদের ওপর এ প্রভাব পড়বে
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার জন্য বছরে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি কানাডিয়ান ডলার (১৬ দশমিক ৪ মার্কিন ডলার) নিয়ে যান দেশটিতে। সরকারের শিক্ষার্থী কমানোর এ পদক্ষেপে বড় বড় প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়বে, যারা শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট। কানাডার অন্টারিও সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ, আন্তর্জাতিক ছাত্রদের সবচেয়ে বড় অংশ এ প্রদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে আসে। রেস্তোরাঁসহ নানা খুচরা খাতের কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আগে সতর্ক করেছে যে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর ক্যাপ বসালে অস্থায়ী কর্মীর ঘাটতি তৈরি হবে। কানাডার রেস্তোরাঁয় এমনিতে কর্মীসংকটের মধ্য আছে। এ ঘাটতি ১ লাখের মতো। এ প্রক্রিয়ার ফলে কর্মীঘাটতি আরও বাড়বে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ২০২৩ সালের হিসাবে, কানাডার রেস্তোরাঁগুলোয় ১১ লাখ কর্মী কাজ করেছেন, এর মধ্য ৪ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী।
নতুন শিক্ষার্থীদের আসার ফলে কানাডিয়ান ব্যাংকগুলো উপকৃত হয়। কারণ, প্রত্যেক ছাত্রকে ২০ হাজার ৬৩৩ কানাডিয়ান ডলার গ্যারান্টেড ইনভেস্টমেন্ট সার্টিফিকেট (জিআইসি) দেখাতে হয়। কানাডায় এখন এক বছরের জন্য পড়তে গেলে টিউশন ফি বাবদ গুনতে হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার ডলার। অর্থাৎ থাকা-খাওয়া বাবদ খরচ, টিউশন ফি ও বিমানভাড়া বাবদ কমপক্ষে ৫০ হাজার কানাডিয়ান ডলার সমপরিমাণের টাকা না থাকলে কানাডায় আবেদন করা যায় না। শিক্ষার্থী কমে গেলে এ অর্থও কমে যাবে।
তথ্যসূত্র: গালফ নিউজ ও রয়টার্স