হবিগঞ্জের আশরাফুল গনি যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বানালেন বাংলা এআই

ছবি: সংগৃহীত

টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটির কলেজ অব মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনের ডক্টরাল শিক্ষার্থী মো. আশরাফুল গনি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রজেক্ট বাংলা এআই তৈরির জন্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স লোকাল নিউজ চ্যালেঞ্জ জয় করেছেন। স্থানীয় পর্যায়ে সংবাদ ও সাংবাদিকতাকে কাজে লাগাতে আমরা কীভাবে এআইয়ের ব্যবহার করতে পারি তার দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে এটি। ভবিষ্যতে এথনিক মিডিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের মূলধারার সাংবাদিকদের জন্যও বাংলা এআই বিশ্বস্ত এআই টুল হবে। কীভাবে এটি কাজ করে, কীভাবে শুরু, পড়াশোনাই বা করেছেন কোথায় এমন নানা দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন আশরাফুল গনি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: যে কাজ করে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন সে সম্পর্কে বলুন

মো. আশরাফুল গনি: যে বিষয়ে কাজ করার জন্য অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি, সেটি হচ্ছে বাংলা এআই। বাংলা এআই হচ্ছে একটি টুল, যেটি ডিজাইন করা হয়েছে ইউএস–ভিত্তিক বাংলা এথনিক মিডিয়ার জন্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলা এথনিক মিডিয়া কী? বাংলা এথনিক মিডিয়া হচ্ছে, প্রবাসীদের বিদেশের বাংলা গণমাধ্যম। আমি বলতে চাচ্ছি যে বাংলা এআই এথনিক মিডিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার গণমাধ্যমের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করবে।

আরও পড়ুন
মো. আশরাফুল গনি
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এ থেকে কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে? সামনের দিনে এটি কী কী কাজে লাগবে?

মো. আশরাফুল গনি: বাংলা এআইতে প্রথমত আমরা মূলত তিন ধরনের সেবা দেব। এক. ভাষা রূপান্তর; দুই. সংবাদের সারসংক্ষেপ করা এবং তিন. সংবাদ খুঁজে দেওয়া। ভাষান্তর অথবা ট্রান্সলেশন টু গুগল ট্রান্সলেটে যে কেউ চাইলেই পারেন। হ্যাঁ, অবশ্যই গুগল ট্রান্সলেটে যে কেউ চাইলেই ট্রান্সলেট করতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, গুগল ট্রান্সলেটের অ্যালগরিদম সংবাদ ভাষান্তর করার জন্য নয়; বরং ভাষান্তরের জন্য।

আমরা ওপেন এআইয়ের ট্রান্সলেশন অ্যালগরিদমকে সংবাদ ট্রান্সলেশন করার জন্য ট্রেইন করব। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কপিরাইট ইস্যু। আপনি চাইলেই যেকোনো সংবাদ ভাষান্তর করে প্রকাশ (রিপাবলিশ) করতে পারবেন না। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক পত্রিকার নিয়ম অনুযায়ী এটা আইনত দণ্ডনীয়। যেহেতু আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে রিপাবলিকেশন চুক্তিতে যাব, তাই বাংলা এআইয়ের গ্রাহকের এ ঝামেলায় পড়তে হবে না। আমাদের এ প্রকল্পে এখনো আমরা বাচ্চা পর্যায়ে আছি। আমরা গবেষণা এবং প্রশিক্ষণের কাজ করছি। আশা করছি, এ মাসের শেষে আমরা আমাদের প্রথম প্রটোটাইপ নিয়ে আসতে পারব।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কীভাবে শুরু করলেন?

মো. আশরাফুল গনি: বাংলা এআই টিমে আমার সঙ্গে আরও দুজন কাজ করছেন। একজন মো. আশরাফুল হক এবং আরেকজন নাবিল মোশারফ হোসেন। আশরাফুল হক অভি আমার টিমে মেশিন লার্নিং এক্সপার্ট এবং নাবিল আমাদের ওয়েব ডেভেলপমেন্টে এবং এই প্ল্যাটফর্মটি তৈরিতে সাহায্য করছেন। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অনেক শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবক (ভলান্টিয়ার) হিসেবে এই প্রজেক্টে যুক্ত আছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর আমি একটা কোর্স করি ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশন এবং জার্নালিজমের ওপর। আমি প্রথম এথনিক মিডিয়া এই টার্মটার সঙ্গে পরিচিত হই এ কোর্সে। পরিচিত হওয়ার পরে আমি কোর্সের অধ্যাপক কেন্ট উইলকিনসনকে অ্যাপ্রোচ করি লন্ডনে বাংলা এথনিক মিডিয়ার ওপর গবেষণা করার জন্য। আমার গবেষণার প্রস্তাব তাঁর পছন্দ হয়। আমি Thomas Jay Harris Institute for Hispanic and International Communication (HIHIC) থেকে গবেষণা করার জন্য অনুদান পাই। গত বছর জুলাইতে আমি লন্ডনভিত্তিক বাংলা এথনিক মিডিয়ার ওপর গবেষণা করতে ইংল্যান্ডে যাই। এ বিষয়ে কাজ শুরু করি। আমি সিলেটের তাই ইংল্যান্ডের বাংলাদেশি কমিউনিটির গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করার আগ্রহ আমার অনেক দিনের।

কাজ করার সময় আমার মাথায় এলো আসলে বাঙালি এথনিক মিডিয়ার সঙ্গে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সার্ভিসটা যোগ করলে কেমন হয়। যেহেতু আমার পিএইচডি গবেষণার মূল কাজ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, তা থেকে বিভিন্ন ধরনের চিন্তাভাবনা মাথায় আসে। সেটা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি এ বছরের জানুয়ারিতে। যখন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি এ কলটা দেয়, তখন আমার মূল গবেষণার ইন্টারেস্ট আর এথনিক মিডিয়ার ইন্টারেস্ট এক করে এই স্টার্ট আপের চিন্তা মাথায় আসে। আমি যেহেতু ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাকগ্রাউন্ডের না, তাই অভি আর নাবিলকে নিয়ে বাংলা এআই টিম গড়ে তুলি। যুক্তরাষ্ট্রে এলে এ কম্পিটিটিভ গ্র্যান্ড পাওয়া খুবই কঠিন এবং সেখানে প্রতিটি বিষয়ে খুবই সুন্দর করে গুছিয়ে লিখতে হয়। সে ক্ষেত্রে আমাকে কলেজ অব মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন, টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটি অনেক সাহায্য করেছে। ইউনিভার্সিটির সাপোর্ট না পেলে অথবা ট্রেনিং না পেলে হয়তো এ ধরনের অ্যাপ্লিকেশন সাবমিট করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী

মো. আশরাফুল গনি: প্রথম লক্ষ্য এই স্টার্ট আপকে টিকিয়ে রাখা। এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। ভবিষ্যতে এথনিক মিডিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের মূলধারার সাংবাদিকদের জন্যও বাংলা এআই একটি বিশ্বস্ত এআই টুল হবে, সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করব।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশে কোথায় পড়াশোনা করেছেন? ফলাফল কেমন ছিল

মো. আশরাফুল গনি: বাংলাদেশে পড়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে অনার্স মাস্টার্স করেছি। মাস্টার্সে প্রথম ছিলাম, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, সিজিপিএ ৩ দশমিক ৯১। সম্ভবত এখন পর্যন্ত এটাই গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সর্বোচ্চ সিজিপিএ। অনার্সে পেয়েছিলাম ৩ দশমিক ৬৪। এসএসসি ও এইচএসসি দুটিতেই জিপিএ-৫ পেয়েছি। বেড়ে উঠেছি হবিগঞ্জ শহরে। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে পাস করি এবং এইচএসসি পাস করি ঢাকা সিটি কলেজ থেকে।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে গেলেন সেটি সংক্ষেপে বলুন

মো. আশরাফুল গনি: বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করার পর আমি কিছুদিন দৈনিক সমকালে প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করি। তারপর আমি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) ২০১৭ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই।

শুরু থেকে ইচ্ছা ছিল পিএইচডি করার জন্য বাইরে যাব। ২০২০ সালে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু করোনার জন্য সেটি পিছিয়ে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসি পিএইচডি করার জন্য। বিইউপিতে বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে আছি। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা ছুটিতে পিএইচডি করছি। গবেষণায় ইচ্ছা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা করছিলাম, পাশাপাশি ফল ভালো ছিল, তাই যুক্তরাষ্ট্রে আসার জন্য তেমন একটা কষ্ট করতে হয়নি। পছন্দমতো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লিকেশন করেছি, তার মধ্যে টেক্সাস টেক থেকে আমি ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পাই। তারপর ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আসি পিএইচডি করার জন্য।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনার সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষকদের মূল্যায়ন কেমন?

মো. আশরাফুল গনি: এখানে সবচেয়ে ভালো যে বিষয়টি শিক্ষাব্যবস্থায়, সেটি হচ্ছে সবাই অনেক পজিটিভ। আপনি এ ধরনের গবেষণা এবং ইনোভেশনকেন্দ্রিক যা–ই ট্রাই করুন না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাকে অনেক বেশি সাপোর্ট দেবে। আমার সুপারভাইজার ডক্টর কার্ক এফ অসম্ভব ভালো একজন মানুষ আর সেই সঙ্গে অসম্ভব ভালো একজন স্কলার। তাঁর ল্যাবে কাজ করে অনেক কিছু শিখতে পারছি এবং প্রতিনিয়ত শেখার চেষ্টা করছি। প্রতিবছর একজন পিএইচডি শিক্ষার্থীর ওপর তার সুপারভাইজার মূল্যায়নপত্র লেখেন এবং এ বছরের মূল্যায়নপত্র কার্ক এফ কি আমার কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আমার পিএইচডির মূল গবেষণার কাজ এখনো বাকি আর সেখানে কাজ শুরু করব খুব শিগগির। সুপারভাইজারের অধীনে সেই কাজ খুব ভালোভাবে করতে চাই।