বিদেশে পড়তে যাওয়া রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অনেকেরই পছন্দের তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা নিয়ে অনেকের মধ্যে যেমন স্বপ্ন আছে, কারও কারও মধ্যে ভয়ও কাজ করে। ভয়ের অন্যতম দিকটা হলো আমি কি অ্যাডমিশন পাব? কিংবা আমার কি ফান্ডিং/স্কলারশিপ হবে? এ ভয়ে অনেককেই মনের সুপ্ত বাসনাকে অঙ্কুরেই কবর দিতে দেখা যায়। এ ছাড়া কারও কারও মধ্যে জিআরই দেওয়ার ভয়, আইইএলটিএস/টোয়েফেলে ভালো স্কোর না পাওয়ার ভয় ইত্যাদিও কাজ করে। কিন্তু আমি বলব, কেউ যদি একবার ভালোভাবে পরিকল্পনা করেন যে ‘আমি উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চাই’ এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করেন, আমার বিশ্বাস, তাঁর পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে আসা সম্ভব।
আমাদের দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ গ্র্যাজুয়েট বের হন, তাঁদের উল্লেখযোগ্য অংশ একটু চেষ্টা করলেই যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসতে পারে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট মেধাবী। সবচেয়ে বড় কথা, যাঁরা ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে এসেছেন, তাঁদের প্রায় অধিকাংশই এখানে ভালো করছে। প্রতিবছর পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশ থেকেই শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে প্রতিবছর কী পরিমাণ শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে আসেন, এটা বলে বোঝানো যাবে না! শুধু এটুকু বলি, আমি যখন ক্যাম্পাসে যাই, বড় কোনো শপে যাই, আর কাউকে দেখি না–দেখি ভারতের কাউকে না কাউকে অবশ্যই দেখব। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে আসার জন্য তাঁরা একটা ট্রেন্ড তৈরি করতে পেরেছেন তাঁদের দেশে। কিন্তু উৎসাহ, পর্যাপ্ত তথ্য, সঠিক নির্দেশনা ও যোগাযোগের ঘাটতির কারণে আমরা পিছিয়ে। তবে আশার কথা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রচুর ফান্ডিং আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো না কোনো ফরম্যাটে ফান্ডিং আছে। টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ (টিএশিপ), রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টশিপসহ (আরএশিপ) নানাভাবে গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্ট্যান্টশিপের সুযোগ রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ফান্ডিং একজন ছাত্রের টিউশন, স্বাস্থ্যবিমাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফি কাভার করে।
কেন যুক্তরাষ্ট্রই উচ্চশিক্ষার জন্য আপনার প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত—এ বিষয়ে কথা বলার আগে আমরা জেনে নেব বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোন দেশ থেকে কী পরিমাণ শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসেন। যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের নিয়ে ২০২৩ ওপেন ডোরস রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনাল এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ১৩ হাজার ৫৬৩ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নিয়েছেন। গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০০ শতাংশ বাড়ায় ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের ৩ হাজার ৩১৪ জন শিক্ষার্থী থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ হাজার ৫৬৩ জন হয়েছে। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী এসেছেন চীন থেকে—২ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৬ জন এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভারত থেকে—২ লাখ ৬৮ হাজার ৯২৩ জন। আমাদের আরেক প্রতিবেশী দেশ নেপাল থেকেও এ শিক্ষাবর্ষে ১৫ হাজার ৯০ জন পড়তে এসেছেন। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া থেকে এসেছেন ৪৩ হাজার ৮৪৭ জন।
এ পর্যায়ে কেন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ও সেরা পছন্দ হওয়া উচিত, সে বিষয়ে আলোচনা করব—
*বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিতি
যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে পৃথিবীর সেরা সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইউএসনিউজ ‘বেস্ট গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং’-এ ১ হাজার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেখানে প্রথম ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেরই ৪০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথিবীর সেরা সেরা গবেষক গবেষণা করে থাকেন।
*অধিকসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় চার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ আছে, যেগুলোয় আন্ডারগ্রেড (অনার্স) বা গ্র্যাজুয়েট (মাস্টার্স ও পিএইচডি) প্রোগ্রাম রয়েছে। বিজ্ঞান, বাণিজ্য, মানবিকসহ সব ধরনের বিষয়ের ওপর ডিগ্রি অর্জনের অবারিত সুযোগ রয়েছে। এর বাইরে বিশেষায়িত বিষয় যেমন মিউজিক, থিয়েটারসহ নানা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের সুযোগ আছে। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন প্রফেশনাল ডিগ্রি ও হাজারো সার্টিফিকেট কোর্স।
*উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা
যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীর যেকোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় উন্নত। এখানে ছাত্রদের একদিকে যেমন বড় গবেষক হিসেবে গড়ে তোলা হয়, অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের এ সময় বিভিন্ন পেশার জন্যও যোগ্য করে গড়ে তোলা হয়। তা ছাড়া এখানকার ক্লাস সিস্টেম, সিলেবাস, ক্লাস ফরম্যাট—সবকিছুই অত্যন্ত পরিকল্পিত ও গোছানোভাবে তৈরি করা। ক্লাস ও গবেষণাগারে রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণ উপকরণ।
*পর্যাপ্ত ফান্ডের ব্যবস্থা
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রচুর ফান্ডিং আছে। বলা যায়, এখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিশেষ করে প্রতিটি বিভাগে কোনো না কোনো ফরম্যাটে ফান্ডিং আছে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমন সুযোগ পাওয়া যায় না। টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ (টিএশিপ), রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টশিপসহ (আরএশিপ) নানাভাবে গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্ট্যান্টশিপের সুযোগ রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ফান্ডিং একজন ছাত্রের টিউশন, স্বাস্থ্যবিমাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফি কাভার করে থাকে। তা ছাড়া শিক্ষার্থীদের মাসিক খরচ বাবদ স্থান ও বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে প্রতি মাসে ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ ডলার পর্যন্ত স্টাইপেন্ডের ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং বিদেশি পড়তে আগ্রহীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রই হতে পারে অন্যতম সেরা গন্তব্য।
এ ছাড়া এখানে গবেষণা করার ক্ষেত্রে রয়েছে অবারিত সুযোগ। অধ্যাপকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফল ও দক্ষতা প্রকাশের মাধ্যমে নিজের পছন্দ অনুযায়ী গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর বৃহত্তম দেশগুলোর একটি। এখানে প্রচুর ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। আছে হাজারো কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে এখান থেকে ডিগ্রি অর্জন করার পর শিক্ষকতাসহ এখানকার ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি করার অবারিত সুযোগ রয়েছে। সর্বোপরি কেউ যদি স্থায়ীভাবে এখানে থাকার চিন্তা করে নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতা বলে সেটারও সুযোগ রয়েছে। এই সব দিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রই বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার প্রথম গন্তব্য হওয়া উচিত। চলবে...
**লেখক: মো. শহিদুল ইসলাম, পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র