‘রাস্তার মাস্টার’ গ্লোবাল টিচার প্রাইজের ফাইনালিস্টে, কে এই নায়েক
বিশ্বের সেরা শিক্ষকদের একটি তালিকায় জায়গা পেয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের জামুড়িয়া তিলকা মাঝি আদিবাসী ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক। তাঁর নাম দীপ নারায়ণ নায়েক। তিনি ‘রাস্তার মাস্টার’ নামে পরিচিত। এখন বিশ্বের সেরা শিক্ষকের মনোনয়নের তালিকায় সেরা দশে আছেন তিনি। ইউনেসকো–সমর্থিত ‘গ্লোবাল টিচার প্রাইজ’-এর আওতায় বিশ্বের সেরা শিক্ষকের পুরস্কারমূল্য এক মিলিয়ন ডলার। আগামী ৮ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেসকোর ৪২তম জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে বিশ্বের সেরা শিক্ষককে বেছে নেওয়া হবে।
এনডিটিভি ও টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, ইউনেসকোর সহযোগিতায় আয়োজিত গ্লোবাল টিচার প্রাইজ ২০২৩-এর ১০ ফাইনালিস্টের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন ভারতের ‘রাস্তার মাস্টার’। ১৩০টি দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষাবিদেরা এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে সবাইকে পেছনে ফেলে ১০ ফাইনালিস্টের তালিকায় উঠে এসেছেন আসানসোলের দীপ নারায়ণ নায়েক। শিক্ষা ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের জন্য গ্লোবাল টিচার প্রাইজ দেওয়া হয়ে থাকে। করোনাকালে সমাজের পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের বিকাশে তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা ইতিমধ্যেই বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
*আসানসোলের আদিবাসী স্কুলে শিক্ষক দীপ নারায়ণ নায়েক
*গ্লোবাল টিচার পুরস্কারের তালিকায় সেরা দশে আছেন দীপ নারায়ণ
*পাকিস্তান, ইউক্রেন, ঘানা, চিলি, কানাডার শিক্ষকও আছেন তালিকায়
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) দীপ নারায়ণ লিখেছেন, ‘২০২৩ সালের ভার্কি ফাউন্ডেশন গ্লোবাল টিচার প্রাইজের ১০ ফাইনালিস্টের মধ্যে নির্বাচিত হওয়ায় আমি অত্যন্ত গর্বিত এবং ধন্য। যে পুরস্কারের সঙ্গে যুক্ত আছে ইউনেসকো এবং দুবাই কেয়ারস। এ অবিশ্বাস্য সম্মানের জন্য ভার্কি ফাউন্ডেশন, ইউনেসকো এবং দুবাই কেয়ারসকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
আসলে কী করেছিলেন দীপ নারায়ণ নায়েক
ভারতে করোনাভাইরাসের সময় লকডাউনে বিভিন্ন স্কুলে অনলাইনে ক্লাস চলছিল। কিন্তু দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছিল না। এ সময় তাদের ত্রাণকর্তা হয়ে আসেন দীপ নারায়ণ। ডিজিটাল বিভেদ ঘুছে ফেলেন তিনি। সবার কাছে পৌঁছে দেন শিক্ষার আলো। বিভিন্ন আদিবাসী গ্রামে রাস্তায় স্কুল তৈরি করেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তিনি শিক্ষার্থীদের পড়াতে শুরু করেন রাস্তার ওপরে। মাটির ঘরের দেয়াল হয়ে ওঠে তাঁর ব্ল্যাকবোর্ড। রাস্তায়ই বস্তা বিছিয়ে পঠন-পাঠন করাতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে আদিবাসী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। গ্রামের কাঁচা বাড়ির দেয়ালগুলোর কোথাও স্বরবর্ণ–ব্যঞ্জনবর্ণ, কোথাও নামতা, কোথাও আবার অঙ্ক কষা থাকত। গ্রামটাই যেন একটা ক্লাসরুম হয়ে ওঠে।
শুধু নিজের তিলকা মাঝি আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়, আশপাশের বিভিন্ন আদিবাসী গ্রামে এ রকম ছোট ছোট স্কুল তৈরি করেন দীপ নারায়ণ। আসানসোলের নামো জামডোবা, পাণ্ডবেশ্বর, পুরুলিয়ায় রাস্তায় স্কুল চলেছে। রাস্তায় পড়ানোর কারণে ‘রাস্তার মাস্টার’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন দীপ নারায়ণ নায়েক। মাটির বাড়ির দেয়াল হয়ে ওঠে ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ড। ক্লাসের জন্য আদিবাসী গ্রামের মাটির বাড়ির দেয়ালে কিছুদূর পরপর ব্ল্যাকবোর্ড লাগানো হতে থাকে। দিনে সূর্যের আলোয় পড়াশোনা চলত। সন্ধ্যা নামলে জ্বলে উঠত মোমবাতির আলো। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বাড়ির অন্য সদস্যদেরও ক্লাস নিতে থাকেন তিনি।
সেই ‘রাস্তার স্কুল’ নিয়ে ২০২১ সালে দীপ নারায়ণ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, প্রথমেই যে খুব সাড়া পেয়েছিলাম, তা নয়। ২০২০ সালের মে মাসে ‘রাস্তার স্কুল’ খোলার সময় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ। ক্রমে আগ্রহ বাড়তে থাকে গরিব আদিবাসী শিক্ষার্থীদের। ২০২১ সালের শেষের দিকে শিক্ষার্থীসংখ্যা গিয়ে ঠেকে এক হাজারের কাছে।
কে এই দীপ নারায়ণ নায়েক
‘যেখানেই দেয়াল আছে, সেখানেই রাস্তা আছে’-এ স্লোগানকে মনেপ্রাণে ধারণ করেন শিক্ষক দীপ নারায়ণ নায়েক। এ স্লোগানেই তিনি শিক্ষার আলো জ্বেলেছেন প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয়। দীপ নারায়ণের স্লোগানের অর্থ জানতে একটু পেছেনে যেতে হবে। ছোটবেলা থেকে পাঁচ ভাই–বোনের সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। দিনমজুর বাবার বই-খাতা কেনার সামর্থ্য না থাকায় অন্যের থেকে চেয়ে নিতেন দীপ নারায়ণ। এমবিএতে ভর্তি হয়েও পড়া হয়নি অর্থের অভাবে। দীপ নারায়ণ বুঝতে পারেন, যেভাবে হোক, একটি চাকরি জোটাতে হবে। ২০১০ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পান পশ্চিম বর্ধমানের জামুড়িয়া গ্রামের দীপ নারায়ণ। নিজের জীবনে শৈশবের দিনগুলো মনে পড়ে তাঁর। শুরু হয় শিক্ষাদানের লড়াই। দুস্থ শিক্ষার্থীদের জন্য বই-খাতা কিনে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পড়ানোও শুরু করেন দীপ নারায়ণ।
সেরা দশে দীপ নারায়ণ নায়েক ছাড়া ঘানা, চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, কানাডা ও ইউক্রেনের শিক্ষকও আছেন।