আমি যেভাবে কাজাখস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পেলাম

লেখকের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
ছবি: বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।

এসএসসি ও এইচসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিলাম। কিন্তু এ জিপিএ-৫-এর শেষ কোথায়? সবাই ভেবেছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সুযোগ পেয়ে যাব, কিন্তু কোথাও হলো না। তারপর এক বছর গ্যাপ দিয়ে আবার শুরু করলাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রস্তুতি। তখন আমি মেডিকেল প্রস্তুতির একটা মেসেঞ্জার গ্রুপে যুক্ত ছিলাম। সেখানে বেশ কিছু বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয়। কিছু বন্ধু বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করত। আসলে মূলত গল্পটার শুরু এখান থেকেই।

মেসেঞ্জার গ্রুপের বন্ধুদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েই বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য কাজ শুরু করি। সময়টা ২০২০ সাল। তখন বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যেসব ডকুমেন্ট লাগে জোগাড় করতে পারিনি। তবে আমার মধ্যে ছিল প্রবল ইচ্ছা শক্তি আর কঠোর পরিশ্রম।

আমি লেগে গেলাম সবকিছু গোছানোর কাজে। সব কটি শিক্ষাবৃত্তিতে আবেদন করা শুরু করলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধ শেষে কোথাও সুযোগ না পেয়ে আমার ঠাঁই হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেক ভালো প্রস্তুতি নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম।

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

আশানুরূপ ফলাফল করতে পারলাম না। এর পর থেকে আমার অনেকটাই মন ভেঙে গিয়ে বাইরে পড়াশোনা করার প্রতি আরও দৃঢ় মনোবল তৈরি হয়েছে। মূলত সরকারি স্কলারশিপগুলোতে নিজে নিজে ঘরে বসে আবেদন করা শুরু করি। প্রথম আমি তুর্কি সরকারি স্কলারশিপ আবেদন করি। সফল হয়নি। তারপরও আমি দমে যায়নি। কারণ, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, একটা স্কলারশিপে আমাকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতেই হবে।

তারপর সব সরকারি-বেসরকারি স্কলারশিপগুলোতে আবেদন করতাম। আমি মনে মনে ভাবতাম, হোক বা না হোক, আবেদন করব।

এরই মধ্য পাসপোর্ট, জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, সুপারিশসংক্রান্ত চিঠি (Recommendation letter), এসওপি জোগাড় করতে থাকি। এখানে বলে রাখা ভালো যে এলওআর, এসওপি—এগুলো আমি অনেক ভাইয়া-আপুর কাছ থেকে জোগাড় করে আইডিয়া নিয়ে নিজের মতো করে লিখতাম। একে একে যখন অনেক স্কলারশিপ আবেদন করে ফলাফল পাচ্ছি না, রিজেক্ট হচ্ছি, খুঁজছিলাম কী কারণে রিজেক্ট হচ্ছে আবেদন।

ভাবলাম কোনো ইমপ্রুভমেন্টের দরকার কি আছে? নিজেকে আরও প্রস্তুত করছিলাম। যেহেতু সবার কাছে শুনেছিলাম, বাইরে যেতে হলে নাকি Educational Credential Assessment (ECA) ভূমিকা অনেক। যেই ভাবা সেই কাজ। নেমে গেলাম বিভিন্ন সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার কাজে। ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর হিসেবে স্বেচ্ছাসেবী (ভলান্টিয়ার) কাজ করলাম। সেই সঙ্গে ইন্টার্নশিপও করছিলাম বেশ কয়েকটা।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বেশ কিছু কোর্স প্রজেক্টে অংশগ্রহণ করেছিলাম। বেশ ভালোই সার্টিফিকেট অর্জন করলাম। এ ছাড়া ফ্রিল্যান্সিংটা শিখে রেখেছিলাম। বাইরে যাব বলে গাড়ি চালানো শিখে রেখেছিলাম। তারপর ফিনল্যান্ড আবেদন করি সেখানেও রিজেক্ট। মালয়েশিয়ার আলবুখারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি, সেখানেও কী কারণে রিজেক্ট করল, বুঝতে পারিনি।

তবে এরই মধ্য ইন্দোনেশিয়ার সোরাবায়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অফার লেটার পাই। তারপর ‘স্টাডি ইন ইন্ডিয়া’র আওতায় জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, দিল্লি থেকে অফার লেটার পাই। আর শেষে কাজাখস্তান সরকারি স্কলারশিপে আবেদন করি। এখানে আবেদনপ্রক্রিয়া ছিল একদম সহজ, জাস্ট ডকুমেন্টগুলো সাবমিট করা। আগেই বলেছিলাম, আমার কাছে সব ডকুমেন্ট জোগাড় করা ছিল, তাই কষ্ট করতে হয়নি। আবেদন করার পর এখানে দুটো ধাপ ছিল—১. সাইকোলজি টেস্ট ও ২. ইন্টারভিউ।

আল্লাহর রহমতে আমি সাইকোলজি টেস্টে পাস করি। তারপর আসে ইন্টারভিউ মেইল। ইন্টারভিউয়ের ব্যাপারে একটু বলি। যেহেতু অনেক স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেছি, ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। মোটামুটি একটা অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল, ইন্টারভিউতে কী ধরনের প্রশ্ন হতে পারে। কী ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারে? তবে এখানে সব থেকে বেশি কাজ করেছে আমার নিজের আত্মবিশ্বাস।

নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করে গেলাম ইন্টারভিউ বোর্ডে। যদিও ইন্টারভিউটি হয়েছিল অনলাইনে। আমার ইন্টারভিউ বোর্ডে একজন ম্যাডাম ছিলেন। তিনি বন্ধুসুলভ ও হাসি-খুশি ছিলেন। আমাকে বেশ স্বাভাবিক প্রশ্ন করেছিলেন। আমি ঠিকঠাক মতো উত্তর দিয়েছিলাম। আর দীর্ঘ দুই মাস পর আমার কাঙ্ক্ষিত স্কলারশিপটি পেলাম। তাও আবার আমার পছন্দের স্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিসে (Space Engineering And Technologies)।

সবশেষ একটা কথাই বলব। নিজের ইচ্ছা শক্তি, সাহস আর পরিশ্রম করতে পারলেই সব সম্ভব। নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। সবার জন্য শুভকামনা।

  • লেখক: মাহতাব অ্যাজমাইন রিফাত,শিক্ষার্থী, বিএসসি ইন স্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিস, আল ফারাবি কাজাখ ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, কাজাখস্তান