২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

উপাচার্যদের মূল্যায়ন কমে যাচ্ছে কেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের একটি মন্তব্য দিয়ে লেখাটি শুরু করি। তিনি বলেন, ‘সমাজবিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগে গত ১০ বছরে যাঁরা অধ্যাপক হয়েছেন, তাঁরা তেমন কিছু লেখেননি, তাঁদের উল্লেখযোগ্য গবেষণাও নেই। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি, তাঁদের লেখাপত্র দেখা হোক, সেগুলো কোনোভাবেই একজন অধ্যাপক হওয়ার যোগ্যতায় উন্নীত হয় না।

অধ্যাপক হওয়ার পর তাঁরা আবার রাজনীতিকের বাসায় গিয়ে বসে থাকছেন ভিসি (উপাচার্য) হতে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তে শুরু করছে। এর ফল আগামীতে আরও খারাপ হবে।’ এই প্রথা ইদানীং শুরু হয়েছে এমন নয়, এটা অনেক পুরোনো কর্মকাণ্ড।

নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন ধরনের স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ রয়েছে অনেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এ রকম অনিয়ম আমাদের জাতির জন্য খুবই লজ্জার। এ রকম অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পরিবারের ৯ সদস্যসহ ৭৩ শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও বলেছে, নিয়োগে অসংগতি আছে।

আরও পড়ুন

এ নিয়োগ নিয়ে এখনো আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ৭৩ জন শিক্ষক নিয়োগের বাতিলের বিপক্ষে কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, নিয়োগ বৈধ ছিল। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সহকারী ও প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ থাকার বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু তারপরও বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ থাকা উচিত ছিল। কিন্তু যেহেতু শিক্ষক নিয়োগ বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী হওয়ায় মানবিক ও সামাজিক দিক বিবেচনায় ৭৩ জন শিক্ষক নিয়োগ বাতিল হওয়া কাম্য নয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন উপাচার্যের নিজ পরিবারের ৯ জন সদস্য নিয়োগ পায় কীভাবে? এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। আবার কোনো এক উপাচার্যের ছেলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়েছেন। যদিও পরে সেই উপাচার্যের ছেলেকে একসময় চাকরি ছেড়ে যেতে হয়। অন্য এক উপাচার্য জামাতা ও নিজের মেয়েকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা শিথিল করেছেন। এ ছাড়া রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সদ্য সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি করে ভাই, শ্যালক-শ্যালিকা ও অন্য আত্মীয়স্বজন এবং পছন্দের লোকদের নিয়োগ দেওয়াসহ নানা ধরনের অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক তদন্তে এসব অনিয়ম ধরা পড়েছে। অনিয়ম করে নিয়োগ দেওয়া অধিকাংশ লোক তাঁর নিকটাত্মীয়। তদন্ত প্রতিবেদনে এসব ঘটনার সত্যতা প্রতীয়মান হয়েছে, কিন্তু এসব খুবই দুঃখজনক। আমাদের শিক্ষকদের জন্য লজ্জাজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকা অবস্থায় চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে, তাঁকেও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন কোনো এক উপাচার্য। কোনো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ যোগ্যতায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছেন উপাচার্য। কিন্তু এর মানে এই নয় যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ ভালো হয় না।

উপাচার্য নিয়োগ নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। কারণ, তাঁকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দিন চাকরি করতে হবে। তাই চক্ষুলজ্জার ভয়ে হলেও অনেক খারাপ কাজ করতে উৎসাহী হবেন না। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হলে তাঁরা নানা কৌশলে চার বছর পার করতে পারলেই শেষ সব দায়িত্ব। যাঁরা তাঁকে জি হুজুর জি হুজুর করবেন, সেসব শিক্ষককে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে থাকেন।
আরও পড়ুন

অধিকাংশ শিক্ষক ভালো ফলাফল এবং পরীক্ষায় শীর্ষ স্থান অধিকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তবে তদবির ও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে শিক্ষক হওয়া বন্ধ করতে পারলে দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণ বয়ে আসবে। কেন এগুলো হয়, এসব খতিয়ে দেখার সময় আসছে। অনেকেই মনে করে উপাচার্য নিয়োগেই গলদ। বঙ্গবন্ধুর আমলে উপাচার্য নিয়োগ ছিল খুবই প্রশংসনীয়। কারণ, তিনি অধ্যাপকদের ফোন করে অনুরোধ করতেন ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য।

তাঁদের নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিল না এবং এ ধরনের কোনো অপকর্ম ওই সময়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে ছিল না। এ জন্য উপাচার্যদের খুবই সম্মান ছিল এবং মূল্যায়ন ইতিবাচক ছিল। কিন্তু এখন দেখা যায়, অনেকেই তদবিরের কারণে উপাচার্য হয়ে যান বলে সমাজে অভিযোগ রয়েছে। যার যত বেশি তদবিরের জোর, তিনি হবেন উপাচার্য। উপাচার্যরা মনে করেন, একবার নিয়োগ দিলে সরকার চার বছরে তাঁকে এ পদ থেকে সরাবেন না। ফলে উপাচার্য নিয়োগ পাওয়ার পর যা ইচ্ছা তা–ই করেন। নিয়োগ পাওয়ার পর তাঁর মনমতো সিলেকশন বোর্ড গঠন করেন। এমনকি সিন্ডিকেটের সদস্যদের পরিবর্তন করে ফেলেন।

যাতে যেকোনো অন্যায় ও যুক্তিহীন বিষয়গুলো সহজেই পাস করাতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নিজের মতো একটা বলয় তৈরি করেন। এরপর শুরু হয় নানা অপকর্ম। যেসব শিক্ষক প্রতিবাদ করবেন, তাঁদের সাইড করে রাখেন কোনো কোনো উপাচার্য। যদি এ রকম হতো যে কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তদন্ত করে প্রমাণিত হলে তাঁকে অপসারণ করা হবে, অন্যায় প্রমাণিত হলে উপাচার্যকে অপসারণ করলে সরকারের ভাবমূর্তি অনেক গুণ বাড়ত বলে মনে করি, তাহলে অনেক অন্যায়, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি কমে আসত।

উপাচার্য নিয়োগ যদি আরও চুলচেরা বিশ্লেষণ করে হতো, রাষ্ট্র ও শিক্ষক সমাজের জন্য মঙ্গল হতো। উপাচার্য নিয়োগে একাডেমিক এক্সিলেন্সি, গবেষণায় দক্ষতা, যেমন আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে কয়েকটি প্রকাশনা আছে, সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা, একই সঙ্গে তাঁদের যে প্রতিষ্ঠান, সেখানে শীর্ষ পদে নেতৃত্ব দিয়েছেন কি না, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী কি না, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। কারণ, উপাচার্য শুধু একাডেমিক বিষয়টি দেখেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক বিষয়ে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ এবং নির্দেশনা দিতে হয়। তাই একজন উপাচার্যের নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টিও জরুরি। কেউ যদি তদবিরের মাধ্যমে উপাচার্য হয়ে যান, পরে এর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষের কথা শুনতে গিয়ে অনেক নীতিবহির্ভূত কাজ করতে হয়।

ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে না পারলে, দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ, প্রায় দেখা যায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে নানা ধরনের অন্যায় ও অনিয়ম। দেখা যাচ্ছে, নিয়োগ পাওয়ার জন্য অনেক জায়গায় বা অনেক ব্যক্তির কাছে তদবিরের জন্য দিনরাত চেষ্টা করা যাচ্ছেন আবেদনকারীরা, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সময় আসছে এগুলো চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসব বন্ধে নীতিমালা করতে পারে, কিন্তু নানা কারণে প্রশাসন এগুলো করে না। অর্থাৎ নিয়ম করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁর পছন্দের লোককে অনেক সময় নিয়োগ দিতে পারবেন না। তাই দুর্বল নিয়ম-নীতিমালা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে থাকেন। শিক্ষক নিয়োগের জন্য লিখিত পরীক্ষা, ডেমো ক্লাস, ব্যাচে ফলাফলে শীর্ষ স্থান (১-৫ মেধাক্রম) এবং মৌখিক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা জরুরি।

উপাচার্য নিয়োগ নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। কারণ, তাঁকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দিন চাকরি করতে হবে। তাই চক্ষুলজ্জার ভয়ে হলেও অনেক খারাপ কাজ করতে উৎসাহী হবেন না। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হলে তাঁরা নানা কৌশলে চার বছর পার করতে পারলেই শেষ সব দায়িত্ব। যাঁরা তাঁকে জি হুজুর জি হুজুর করবেন, সেসব শিক্ষককে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে থাকেন।

এমনকি নিয়মের তোয়াক্কা না করে শিক্ষকদের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। সর্বোপরি, উপাচার্যদের এসব অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে মানুষ  তাঁদের অতীতের মতো সম্মান ও মূল্যায়ন করে না। তাই শিক্ষকদের উচিত উপাচার্য হলে তাঁর ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা। অর্থাৎ শিক্ষকদের সার্বিক মর্যাদা রক্ষা করার লক্ষ্যে আমাদের সবার কাজ করা উচিত।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ